Icon to view photos in full screen

" আমরা কী পারি আর কী পারি না সে ব্যাপারে সমাজ সব সময়ই নাক গলায়। এর পরিবর্তন হওয়া দরকার।"

থিরুবনন্থাপুরমের কোনো এক বাসস্ট্যান্ডে সাদা বেতের লাঠিটা নিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল টিফ্যানি। একজন বয়স্ক মহিলা সব্জিবিক্রেতা হেঁটে এসে ওর হাতে দশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী টিফ্যানি বোঝানোর চেষ্টা করল যে, তার আর্থিক কোনো অসুবিধে নেই কিন্তু সেই মহিলা টাকাটা ফেরত নিতে অস্বীকার করল। একজন অন্ধ দুর্বল মানুষকে সাহায্য করার পুণ্য থেকে নিজেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত করতে চায় না সেই মহিলা।
 
শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষেরা অসহায় -- এই ধারণা সমাজের শিক্ষিত লোকজনরাও পোষন করে থাকেন। মানুষ আমাকে জিগ্যেস করে, " নিজে নিজে স্নান করতে পারো? জামাকাপড় পরতে পারো? " তিরিশ বছরের টিফ্যানি হাসতে হাসতে বলল। অচেনা লকজনও ওর বাবাকে জিগ্যেস করে, কেন তিনি মেয়ের বিয়ে দেননি। দেশের বাইরে গেলে কী করে টিফ্যানি একা সব সামলায় ভেবে বন্ধুরাও অবাক হয়ে যায়।
 
টিফ্যানি কিন্তু বরাবরই স্বাধীন ছিল না। অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতেন ওর অভিভাবকরা। ফলে নিজের কাজ নিজে করতে শেখেনি সে। টিফ্যানির মা মারা যান যখন ওর ১২ বছর বয়েস। টিফ্যানির বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওঁর বদলি হত। বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে টিফ্যানিকেও একাধিক স্কুলে পড়তে হয়েছে এবং বেশির ভাগ জায়গাতেই বৈষম্যের শিকার হয়েছে সে। হাইস্কুল হোস্টেলে থাকার সময় ওকে দেখাশোনা করতেন বিনীতাদিদি। তার সঙ্গে এক গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল টিফ্যানির, প্রায় মায়ের সমপর্যায়ের। সেই বিনীতাদিদি ওকে শিখিয়েছিল কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে হয়। ১৮ বছর বয়েস পর্যন্ত বাইরে বেরলে একজনের সাহায্য লাগত টিফ্যানির। তারপর যান্ত্রিক সাহায্য নিয়ে একাই বেরতে পারত।
 
সাদা বেতের এই লাঠিটা ওকে স্বাধীনতা দিয়েছে। লাঠি ঠুকে ঠিকে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো, বাসে চড়া সবই করত টিফ্যানি। ইংরেজি নিয়ে স্নাতক হবার পর বিএড করে সে। কাজ করতে শুরু করে, বিকলাঙ্গ মানুষের কল্যানের দাবীতে আন্দোলনে অংশ নেয়, প্যারাগ্লাইডিং, স্কাইডাইভিং -- সমস্ত কিছুই করে টিফ্যানি। ২০১২ সালে ' জ্যোতির্গময়া ফাউন্ডেশন' এর প্রতিষ্ঠা করে টিফ্যানি। এখানে দৃষ্টিশক্তিহীন ছেলেমেয়েদের যোগব্যায়াম, চলাফেরার কায়দা, উন্নত জীবন ধারণের পদ্ধতি, কম্পিউটার শিক্ষা এবং অন্যান্য আরও প্রয়োজনীয় ব্যাপারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখানে থাকারও ব্যবস্থা আছে। এই ফাউন্ডেশনের একটি চলমান বিদ্যালয়ও আছে ( মোবাইল স্কুল)। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামীণ এলাকার দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষদের কাছে পৌঁছে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এরা। 
 
বাবার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার ফলে মালায়লাম থেকে শুরু করে নেপালী, তামিল, ইংরেজি বলতে পারে টিফ্যানি। নিজের মাতৃভাষা হিন্দি তো আছেই। কাল্পনিক কাহিনি ( ফিকশন) পড়তেই বেশি ভালোবাসে টিফ্যানি। বিশেষ করে মহিলা সাহিত্যিকদের লেখা, তাদের চোখ দিয়ে দেখা যৌথ পরিবারের গল্প। যেমন, অনিতা দেশাইয়ের ' ফাস্টিং ফিস্টিং ', কিরণ দেশাইয়ের ' দ্য ইনহেরিটেন্স অফ লস'।  ওর নিজের মতো করে যাতে অন্যরাও বাঁচতে পারে এবং রোজগার করতে পারে সেটাই টিফ্যানির জীবনের লক্ষ্য। এক কথায়, টিফ্যানির বক্তব্য, " অক্ষমতাই সম্ভাবনা "।
 

ছবি:

ভিকি রয়