Icon to view photos in full screen

" পেছনে তাকিও না। পেছনে তাকালেই তুমি সেখানেই আটকে যাবে, এগোতে পারবে না।"

লোকটা চিৎকার করে বলেছিল, " এমন হাল করব যে বেঁচে থাকবে কিন্তু কারুর সামনে যেতে পারবে না। " কিন্তু এই তড়পানি ফাঁকা বুলি হয়েই থেকে গেছিল। কারণ এই দানবের কথার প্রতিবাদে মেয়েটা বলেছিল, " আমার পরিচয়কে তুমি কোনোভাবেই মুছে ফেলতে পারবে না। আমার আত্মবিশ্বাসের গভীরে এর মূল গাঁথা আছে। " 
 
যে মহিলারা মিলে শিরোস হ্যাংআউট ক্যাফে চালায়, তারা ক্যাফের অন্দরসজ্জার মতোই উজ্জ্বল। ওদের টি-শার্টগুলোতে বহুরঙা মেয়ের মুখ আঁকা আর তার নীচে লেখা, ' আমার হাসিই আমার সৌন্দর্য ' ( My beauty is my smile) পেছনদিকে লেখা ' অ্যাসিড অ্যাটাক বন্ধ হোক ' ( Stop acid attack) ।
 
ছানভি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অলোক দীক্ষিত এই রেস্টুরেন্টটি চালু করেছিলেন। প্রকৃতিতে যত রঙ আছে তার সবগুলোকেই তিনি ব্যবহার করেছেন রেস্টুরেন্টের অন্দরসজ্জায়। দেওয়ালের একটা অংশে উজ্জ্বল রঙ দিয়ে চোখে পড়ার মতো ভাস্কর্য, সুন্দর সুন্দর বাঁধানো ছবি দিয়ে সাজানো। তার সঙ্গে আছে স্টিলের চামচ দিয়ে তৈরি দুটো ডানা যার মাঝখানে কর্মরত মেয়েদের নামের তালিকা। বইয়ের তাকগুলোতে ভর্তি বই। ইচ্ছেমতো পড়া যায়, নাড়াচাড়া করা যায় অথবা দানও করা যায়। এছাড়া হাতে তৈরি জিনিসপত্র এবং জামাকাপড় আছে যা কেনা যায়। " যেমন ইচ্ছে টাকা দাও " পদ্ধতিতে খাবারও পরিবেশন করা হয়।
 
অতিমারীর কারণে পর্যটকের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে যাওয়ায় এই ক্যাফে প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। কিন্তু তাও এখানকার মহিলা কর্মচারীরা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো যেমন চিরকাল জানায়। দু শিফটে ১০ জন কাজ করে। এর ভেতর পাঁচ জনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম। প্রত্যেকেই গরীব ঘর থেকে এসেছে। এদের কিশোরী বয়েসেই এরা অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিল। আলিগড়ের রুকেয়া খাতুন (৩৭) হল সাত ভাইবোনের মধ্যে চার নম্বর। ওর স্বপ্ন ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হবার। যখন ওর ১৪ বছর বয়েস, সেই সময়ে রুকেয়ার মা ওকে পাঠান ওর দিদির দেখাশোনা করার জন্য। স্বামীর অত্যাচারে দিদির পেটের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। সেই বাড়িতেই থাকত দিদির দেওর। তার নজর ছিল রুকেয়ার ওপর। বিয়ে করতে চেয়েছিল ওকে। কিন্তু রুকেয়ার মা রাজি হয় না। সেই রাগে রাত্রিবেলা মত্ত অবস্থায় এসে রুকেয়াকে ধরে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মেয়েটির ডাক্তারি পরিষেবাও জোটে না। রুকেয়ার দাদা নিজের সাইকেল বন্ধক দিয়ে ওর চিকিৎসার খরচ মেটায়।
ডলির (৩০) ইচ্ছে ছিল সে ডাক্তার হবে। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়েসে অ্যাসিড হামলা হয় তার ওপর। রূপার ( ২৭) যখন ১৪ বছর বয়েস তখন ওর সৎ মা রূপার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে। মধু (৪০) বিয়ের প্রস্তাব খারিজ করাতে সেই লোক অ্যাসিড ঢেলে দেয় ওর মুখে। তখন মধুর বয়েস মাত্র ১৭ বছর। ওর মা পুলিশের কাছে যেতে পারেনি কারণ লোকটা মধুর ছোট ভাইকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিল। বিজনরের বালা প্রজাপতি যখন ১৭ বছরের, তখন ওর মাকে এক দুশ্চরিত্র লোকের হাত থেকে বাঁচায়। প্রতিশোধ নিতে সেই লোক ওদের সমস্ত গবাদি পশুকে মেরে ফেলে এবং বালার মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। এখন বালার বয়েস ২৬।
 
অন্ধকারে থাকা বছরগুলোর মনোকষ্ট এবং যন্ত্রণা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল। বেশির ভাগ মেয়েই কোনো বিচার বা ক্ষতিপূরণ পায়নি। প্লাস্টিক সার্জারি করা তো তাদের সাধ্যের বাইরে। শহরের আক্রান্তরা যেটুকু সহায়তা পায় গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা সেটুকুর থেকেও বঞ্চিত। তাদের লড়াইটা একান্ত নিজস্ব।
 
ছানভি ফাউন্ডেশন তাদের এক নতুন জীবন এবং নতুন পরিবার দিয়েছে-- সক্কলে একসঙ্গে বলে উঠল। ন'বছরের ছেলের মা রুকেয়া বলল, " মুখ ঢেকে রাখতে আগে আমি বুরখা পরতাম। কিন্তু এখন আমি জিন্স আর টি-শার্টেই বেশি স্বচ্ছন্দ।" রান্না করতে ভালোবাসে রুকেয়া। ওর ভাইয়ের একটা চলমান খাবারের স্টল আছে, সেখানে খাবার সরবরাহ করে ও। এক না একদিন ক্যাফের রান্নাঘরে রান্না করার ইচ্ছে খুব। 
 
রেস্টুরেন্টের হিসেবপত্র আর বুটিক সামলায় রূপা। ওর কথায় এই ক্যাফে ওকে এ-ই দুনিয়ায় নিজের মতো করে চলার সাহস যুগিয়েছে, নিজের প্রতিভাকে সামনে আনতে সাহায্য করেছে। মহিলাদের পোষাকের ডিজাইন করে রূপা। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে পোষাক বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করার।
 
এদের মধ্যে ডলি একমাত্র ব্যতিক্রম। সে তার অত্যাচারীদের জেলও খাটিয়েছে এবং ক্ষতিপূরণও আদায় করে ছেড়েছে। চলবলে মেয়েটা খদ্দেরদের অর্ডার নেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। নাচতে ভালোবাসে ডলি। ভবিষ্যতে ডান্স অ্যাকাডেমি খোলার স্বপ্ন দেখে ও।
মধুর প্লাস্টিক সার্জারি করানোর জন্য ওর মা প্রচুর পরিশ্রম করে যাতে কিছু টাকা জোগাড় হয়। মধু বিএ পাশ করেছে। তারপর ওর বিয়ে হয়। এখন তিনটি বাচ্চার মা ও। অতিমারীর কালে ওর স্বামীর কাজ চলে গেছে। ফলে মধুকে সংসার সামলানো থেকে শুরু করে তিনটে বাচ্চাকে বড় করে তোলার দায়িত্বও নিতে হয়েছে। ছানভি ফাউন্ডেশন দক্ষতা অনুযায়ী মহিলাদের প্রশিক্ষিত করে থাকে। বিশেষ করে এই লকডাউনের সময়ে। এর মধ্যে মধুর আকর্ষণ ভিডিও এডিটিং -এর কাজে। কম্পিউটারের কাজে দক্ষতা আছে মধুর। ডাটা এন্ট্রি জাতীয় কাজ ভালোমতোই করতে পারে ও।
 
" আমাদের গ্রামে মেয়েরা কেবল ক্লাস ফাইভ অবধিই পড়তে পারে। " বালা বলল। কাজের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার সুযোগ দিয়েছে এই ফাউন্ডেশন। " মুখে ক্ষত আছে বলেই আমাদের জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়নি।" সব শিরোসদের পক্ষ থেকে এই বার্তাই দেয় বালা। 

ছবি:

ভিকি রয়