মহম্মদ সুলতান শ্রীনগর রাজ্যে অবস্থিত গোটাপোরা গ্রামের স্বনামধন্য পশমিনা শিল্পের কারিগর । দুর্ভাগ্যক্রমে, তাঁর তিন ছেলেই মাসকুলার ডিসট্রফি রোগে আক্রান্ত। এই অসুখে পেশী দুর্বল হতে হতে চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। একজনের এই রোগই সামলানো মুশকিল সেখানে সুলতানের তিন ছেলেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দুঃখের সমুদ্রে ডুবে থাকতেন সুলতান।
এখন কিন্তু সত্তর বছরের মহম্মদ সুলতান সেই ভয়ঙ্কর দুঃখের দিনগুলোকে পেছনে ফেলে এসেছেন। এর কারণ, তাঁর ছোট ছেলে তারিক আহমেদ মির ( ৩২) কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী সুজনি শিল্পের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। এটা অত্যন্ত গর্বের কথা। পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কারিগর অন্যান্য বেশ কিছু কারিগরকে সঙ্গে নিয়ে ২০১০ সালে স্পেশাল হ্যান্ডস অফ কাশ্মীর ( Special Hands of Kashmir) নামে একটা সংগঠন তৈরি করে। " আমার মতো প্রতিবন্ধী কারিগরদের একটা সুযোগ করে দেবার চেষ্টা করেছি ", বলে তারিক। এই সংগঠনের মাধ্যমে ৪০ জন কারিগর তাদের জীবিকানির্বাহ করছেন যার মধ্যে ১৫ জন প্রতিবন্ধী।
লেখাপড়া করাটা তারিকের কাছে ছিল অসম্ভব এক লড়াই। তারিকের প্রাথমিক স্কুল ছিল ২ কিলোমিটার দূরে। হেঁটে যেতে কী অমানুষিক কষ্ট করতে হত বলার নয়। হাইস্কুল ছিল বদগামে। সেখানে যেতে বাসে চড়তে হত। সেটাও খুবই কষ্টকর ছিল। তারিকের খুব ইচ্ছে ছিল ওষুধবিষুধ নিয়ে পড়ার। কিন্তু তার জন্য তাকে ২০ কিলোমিটার বাসে করে যেতে হত। এতটা সম্ভব ছিল না বলে তারিক কলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে। এক বছর শ্রীনগর কলেজে পড়ার পর দূরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির মাধ্যমে স্নাতক হয় তারিক। এরপর কাশ্মীর ইউনিভার্সিটি থেকে ঊর্দু সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর করে। ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার কারণে একখানা চাকরিও জোটেনি ওর কপালে । মিরজা গালিব এবং আল্লামা ইকবাল ওর প্রিয় কবি। ওঁদের লেখার মায়াময় শব্দ তারিকের হৃদয়কে স্নিগ্ধ করে।
ছোটবেলায় তারিক লক্ষ করত, কী ভাবে ওর বাবা পশমিনা শাল বুনছেন। শীতকালের তিনমাস ছুটির সময় বাবাকে কিছুটা সাহায্য করত সে। এখন ও ঠিক করেছে, এই শিল্পকেই পেশা হিসেবে নেবে। নাম মাত্র দামে দালালদের কাছে বেচতে বেচতে বিরক্ত হয়ে তারিক সিদ্ধান্ত নেয় , ব্যবসার গতি প্রকৃতি পালটে ফেলবে। বৃত্তি হিসেবে পাওয়া ১০,০০০ টাকা দিয়ে একটা স্মার্ট ফোন কেনে ও। ( ' এই টাকায় আমাদের এক বছরের খোরাক হয়ে যেত ' এই বলে বাবা মা বকা দিয়েছিলেন সেই সময়)। এরপর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সুজনি শালের ছবি পোস্ট করে তারিক । খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন সংগঠন থেকে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করে। ওদের দল বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিতে শুরু করে। নানা জায়গা থেকে সহযোগিতা এবং বৃত্তি পেতে লাগে তারিক, দেশের মানুষ চিনতে শুরু করে ওকে, সুনাম বাড়তে থাকে তারিকের।
২০১৯ সালে তারিকের ভাই নাজির আহমেদ মারা যায়। আর এক ভাই, ফারুক আহমেদ ৯০% প্রতিবন্ধকতা নিয়েও হিসেব রাখার কাজে সাহায্য করে তারিক কে। দু ঘণ্টার লম্বা বিরতি ছাড়া সকাল ৯ টা থেকে রাত্রি ৯ টা পর্যন্ত কাজ করে তারিক। ওর হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে ইকবালের শায়েরির একটা পংক্তি দেখতে পাওয়া যায়, ' সিতারো সে আগে জাঁহা অর ভি হ্যায় ' ( তারাদের জগতের বাইরেও জগত আছে)। এই কথাগুলো অসীমকে স্পর্শ করতে উদ্দীপ্ত করে তারিক কে।