Icon to view photos in full screen

“প্রতিদিন আমি লুডো খেলি এবং বাবার জন্য অপেক্ষা করি—তিনি আমার পছন্দের চকলেট নিয়ে বাড়ি ফেরেন।”

ভারতে কতজন মানুষ সেরিব্রাল পালসি (CP) আক্রান্ত ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারবেন? নিশ্চয়ই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের হ্যাভলক আইল্যান্ডের এক পর্যটক গাইড সত‍্যজিৎ মণ্ডল তা পারবেন না।
 
CP–র চিকিৎসা (যা সারাজীবনের) খরচ নিয়ে সামান্য অনলাইন অনুসন্ধান করলেই আপনি দেখতে পারেন যে চোখ কপালে তোলা এক মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয়। ফিজিও এবং স্পিচ থেরাপির পাশাপাশি সহায়ক উপকরণ ও ডিভাইস ছাড়াও আছে নানারকম প্রতিদিনের ওষুধ—মস্তিষ্ক শান্ত রাখার জন্য, খিঁচুনি (ফিটস) প্রতিরোধের জন্য এবং মাংসপেশি সচল রাখার জন্য যাতে অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া কমে। সত‍্যজিৎ এবং তাঁর স্ত্রী সঙ্গীতা, ভারতের অধিকাংশ CP-আক্রান্ত শিশুর মা–বাবার মতোই, ‘যখন থেরাপি পাওয়া যায়, যখন সামর্থ্য থাকে তখন ওষুধ’—এই মডেলে চলেন। পরিবারের সাহায্যে তাঁরা তাঁদের ১২ বছরের ছেলে সুমিথের জন্য যথাসাধ্য করেন।
 
শিশুটি তার হাত সবসময় মুঠো করে রাখে কিন্তু সেটা দেখে সঙ্গীতা খুব বেশি দুশ্চিন্তা করেননি। কিন্তু যখন সে হামাগুড়ি দিতে পারল না তখন সন্দেহ জাগে। তবে শাশুড়ি মায়া রানির কথায়, “কিছু বাচ্চার দেরি হয়।” একবার শিশুটির ৩০ মিনিট ধরে খিঁচুনি হয়েছিল। এক বছর বয়সেও যখন সে বসতে পারছিল না, তখন দম্পতি ডাক্তার দেখান। “এখানকার ডাক্তাররা ছ’মাস ওষুধ দিলেন, তারপর বললেন, পোর্ট ব্লেয়ারের ডাক্তারদের দেখাতে,” স্মরণ করেন সঙ্গীতা। “সেখানে গেলে তাঁরা বলেন, এত দেরি করে এলেন কেন?”
 
আরোগ্যের আশায় তাঁরা পোর্ট ব্লেয়ারের বেশ কিছু ডাক্তার দেখান। সঙ্গীতা নিয়মিত সুমিথের মালিশ ও ফিজিও করাতেন, দিনে দুইবার, কিন্তু তেমন উন্নতি হয়নি। শেষে তাঁরা কেরালার মাতা অমৃতানন্দময়ী মঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। “আমাদের যাওয়ার খরচ তুলতে শ্বশুরমশাই জমি বিক্রি করেছিলেন,” বলেন সঙ্গীতা। সেখানে প্রায় দুই মাস ছিলেন তাঁরা। সুমিথ সারাদিন মালিশ, ব্যায়াম ও ওষুধ পেতো। তিন মাস পর আবার যেতে বলা হয় এবং বলা হয় হাত বা পা—কোনটার দিকে মনোযোগ দিতে চান। তাঁরা হাত বেছে নেন যাতে দৈনন্দিন কাজগুলোতে সুবিধা হয়।
 
দ্বিতীয় দফা চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে তাঁরা কঠোরভাবে মালিশ–ব্যায়াম–ওষুধের রুটিন মেনেছিলেন। এসময় সঙ্গীতা গর্ভবতী হন। প্রথম কয়েক মাস ভারী কিছু তুলতে বারণ করা হয়। “কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? প্রতিদিন সুমিথকে কোলে নিতে হত, তার ব্যায়াম করাতে হত, শক্ত শরীরে জোরে চাপ দিতে হত,” বলেন সঙ্গীতা। “তৃতীয় মাসে আমার গর্ভপাত হয়।”
 
ছ’মাস পরে আবার গর্ভবতী হন তিনি। এবার সম্পূর্ণ শয‍্যাশায়ী থাকতে বলা হয়। সুমিথের ফিজিওথেরাপি বন্ধ হয়ে যায়। শিভু জন্মানোর পর সঙ্গীতা শিশুর দেখাশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং কয়েক বছর সুমিথের ব্যায়ামে মন দিতে পারেননি, যদিও তাকে সবসময় বলা হত “নড়ো, চেষ্টা করো শরীর নাড়াতে।”
 
তার কথা অস্পষ্ট: “আমরাই শুধু বুঝতে পারি,” বলেন সঙ্গীতা। “শিভুকে ডাকতে চেষ্টা করে, ‘ভাআইই’ বলতে পারে।”
 
শিভু এখন চার বছর বয়সী, আর তিন মাস আগে সঙ্গীতা আবার সুমিথের রুটিন শুরু করেছেন। শ্বশুর–শাশুড়ির নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন না থাকলে তাঁদের টিকে থাকা কঠিন হত বলে তিনি জানান। সত‍্যজিৎ–এর বাবা–মা ও দুই ভাইয়ের বাড়ি কাছাকাছি, পাশাপাশি। “সকলেই সবার খেয়াল রাখে,” বলেন সঙ্গীতা। “আমার শ্বশুর–শাশুড়ি ধনী নন, কিন্তু আমাদের জন্য যা সম্ভব সব করেছেন। বলেছেন, তোমরা সুমিথকে দেখো, আমরা তোমাদের দেখব। শিভু তার বাবার সঙ্গে স্কুলে যায়, আর আমি তাকে আনতে গেলে শ্বশুরমশাই সুমিথকে দেখাশোনা করেন। আমি না পারলে অন্য কেউ যায়।”
 
সুমিথ তার বাঁ হাতে হালকা জিনিস তুলতে পারে। শিভু টিউশন থেকে ফিরলে সে তার সঙ্গে খেলতে খুব ভালোবাসে। তার একটা ত্রিচক্রযান আছে—প্যাডেল করতে না পারায় কনুই দিয়ে চালায়। ফোন ব্যবহার করে, আর ডিজিটাল ট্যাবেও লিখতে পারে—স্টাইলাস মুখে চেপে। শিভুকে পড়াতে বসলে সুমিথও পাশে বসে শেখার চেষ্টা করে।
 
তার নিজের বানানো দৈনিক রুটিন আছে—একদম কঠোরভাবে মেনে চলে। সকাল ৬টা ৩০–এ সে নিখুঁতভাবে ঘুম থেকে ওঠে, সঙ্গীতাকে সঙ্গে সঙ্গে তার দাঁত ব্রাশ করিয়ে জামাকাপড় পাল্টাতে হয়। টয়লেটে যাওয়ার সময়ও নির্দিষ্ট! সে লুডো খুব ভালোবাসে এবং প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে খেলতে চায়। দুপুরের খাবার ঠিক ৩টেতেই। টিভি দেখার সময়ও বাঁধা—সকালে টম অ্যান্ড জেরি, আর দুপুরের পর ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশ্মা’।
 
সত‍্যজিৎ কাজের জন্য ফেরিতে করে এলিফ্যান্ট বিচে যান। “প্রতিদিন সুমিথ আমার কাছে কিছু না কিছু নিয়ে আসার আশা করে,” তিনি বলেন। “চকলেট সবচেয়ে পছন্দ।” তিনি আরও বলেন, “ও যদি একটু সুস্থ হয়ে উঠত, তবে আমাদের সব স্বপ্ন পূরণ হত।”

ছবি:

ভিকি রয়