পাটনার সঞ্জীব কুমারের বিশ্বাস, তাঁর একমাত্র ছেলে শিবেশ আনন্দের সঙ্গীতের জন্য আগ্রহের প্রদীপটা সম্ভবত তার জন্মের আগেই জ্বলে উঠেছিল। তাঁর স্ত্রী অনিতা প্রসাদ গর্ভবতী অবস্থায় যখনই গান গাইতেন বা মিউজিক প্লেয়ারে কোনও গান চালাতেন, তখনই পেটের ভিতরে শিশুটি পা ছুঁড়ে সাড়া দিত। এই তত্ত্বটি যথাযথ হোক বা না হোক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে অধুনা ২৩ বছর বয়সী শিবেশ, শৈশব থেকেই সঙ্গীতে অসাধারণ প্রতিভাবান। অনিতার কথায়, "সঙ্গীত ওর কাছে যেন ঈশ্বরের উপহার।
এই পরিবারটি তখন ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে থাকত। শিবেশের যখন মাত্র ১০ মাস বয়স ছিল তখন থেকেই সে সারাদিন বিভিন্ন গানের ক্যাসেট চালিয়ে শুনত এবং সেইসব গানের সঙ্গে সঙ্গে নিজে গুনগুন করার চেষ্টা করত। তার প্রায় সাড়ে তিন বছর বয়সে শিবেশের দাদুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় প্রথম তার সাঙ্গীতিক ক্ষমতা প্রকাশ পায়। অনিতা স্মৃতি রোমন্থন করেন: “আমার বাবা একজন খুব ভালো গায়ক ছিলেন। তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠানে, আমি শিবেশকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে কোনও গান করতে চায় কিনা। কারণ ওর দাদু ছিলেন সঙ্গীত অন্ত প্রাণ। শিবেশ তখন আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে একেবারে নিখুঁত সুরে মহম্মদ রফির ‘বাহারো ফুল বরসাও’ গানটি গেয়ে শুনিয়েছিল!"
ওই বয়সেই তার শারীরিক অক্ষমতাটিও প্রকাশ পায়। শিবেশ ব্যাঙ্ক কলোনিতে একটা বালির ঢিবিতে গিয়ে (সঞ্জীব একজন পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের কর্মচারী) সেখানে চুপচাপ একা বসে থাকত, কিছুই করত না। তার বাবা-মা বুঝতে পেরেছিলেন যে "কিছু একটা গড়বড় হয়েছে"। তাঁদের ভয়টা নিশ্চিত হল যখন এলাকার স্কুল ছেলেটিকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করল; কারণ হিসেবে একজন শিক্ষক তাঁদের ডেকে বলেছিলেন যে শিবেশ একজন 'বিশেষ' চাহিদাসম্পন্ন শিশু।
সঞ্জীব তাঁর ছেলের জন্য সবচেয়ে সেরা পরিকল্পনাটি করতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেননি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের দেখাশোনার জন্য একটি অপেক্ষাকৃত বড় শহর পরিকাঠামোগত দিক থেকে আরও উন্নত হবে, সেটা বুঝতে পেরে তিনি তৎক্ষণাৎ একটি বদলির আবেদন করেন এবং দ্রুত তাঁর মা অনিতা এবং ছেলে শিবেশকে পাটনায় স্থানান্তরিত করেন। সেখানকার একজন চিকিৎসক শিবেশের মধ্যে সামান্য অটিজমের লক্ষণ থাকার বিষয়টা নিশ্চিত করলেন। সঞ্জীব বললেন, “তিনি আমাদেরকে বললেন, শিবেশের সঙ্গে বিভিন্নরকম কাজে যুক্ত হয়ে তার মধ্য দিয়ে তার ভিতরে থাকা ইতিবাচক দিকগুলি চিহ্নিত করতে হবে। তারপর সেগুলির যথোপযুক্ত বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।" একটা সরকারী নীতি আছে, যেখানে পরিবারে আপনার উপর নির্ভরশীল কোনো প্রতিবন্ধী শিশু থাকলে আপনার কর্মক্ষেত্র আপনি নিজেই বেছে নিতে পারবেন এবং আপনাকে আর অন্যত্র বদলি করা হবে না। সঞ্জীব এই নিয়মটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন।
শিবেশ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত একটি মূলধারার স্কুলে পড়ে। তারপর অবশ্য STEM বিষয়গুলির সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। স্কুলে থাকাকালীন সে স্কুলের সমস্ত অনুষ্ঠানে এমনকি শহরের নানা জনসাধারণের অনুষ্ঠান মঞ্চেও গান গাইত। তার বাবা-মা তাকে ওই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গানের ক্লাসে ভর্তি করেন। আর বাড়িতে শিবেশকে ইংরেজি, হিন্দি এবং গণিত শেখানোর জন্য তাঁরা একজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ করলেন। হাঁসের কাছে জলে নামা যেমন সহজ, গানটাও শিবেশের কাছে ঠিক তেমনই মনে হল; সে শুধু গানই করে না, হারমোনিয়ামও বাজাতে পারে। বর্তমানে সে প্রয়াগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। দুই বছর আগে জেলাস্তরের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় সে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দ্বিতীয় এবং লোকসঙ্গীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। ২০২০ সালে একটি অনলাইন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় সে প্রথম হয়েছিল। “আমরা সম্প্রতি গানের রিয়েলিটি শো সা রে গা মা পা-তে ওর অডিশন টেপটি পাঠিয়েছি, এখন ওঁদের তরফ থেকে ভাল কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছি,” সঞ্জীব আমাদের জানালেন।
শিবেশের ক্রীড়ানৈপুণ্যের দিকটি ২০২২ সালে খানিকটা দৈবক্রমেই আবিষ্কৃত হয়। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হিসাবে সঞ্জীব এমন একজন গ্রাহকের সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছিলেন, যিনি ঘটনাচক্রে ছিলেন একজন আমলা। তিনি খেলাচ্ছলেই পাটলিপুত্র স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠেয় একটি টুর্নামেন্ট দেখার জন্য সঞ্জীবকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে, সঞ্জীবের সঙ্গে আলাপ হয় সন্দীপ কুমারের। যিনি তাঁর জিমন্যাস্টিকসের প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেন(এবং যাঁর গল্প আমরা এর আগে EGS-এ তুলে ধরেছি)। ওই প্রতিষ্ঠানে শিবেশের লং জাম্প এবং সাইক্লিংয়ের প্রতিভা চিহ্নিত হয় এবং তাকে এই খেলাগুলিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। "গত বছর সে জাতীয় স্তরে দীর্ঘ লম্ফনের জন্য স্বর্ণপদক জিতেছিল!" তার গর্বিত বাবার বক্তব্য এটি। “বিহার সরকার তাকে সম্মানিত করেছে, আর নগদ ₹২ লাখ টাকা পুরস্কারও দিয়েছে। আমরা আশা করি ও একদিন প্যারা অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে।” অনিতা আর পাঁচজন মায়ের মতোই প্রশংসার সুরে বলে ওঠেন- “খেলাধুলা করে ওর শরীরের বেশ উন্নতি হয়েছে। ওকে এখন স্মার্ট এবং ফিটফাট দেখাচ্ছে!"
শিবেশ সকাল 5 টায় ঘুম থেকে ওঠে। খেলাধুলা এবং সঙ্গীতে পরিপূর্ণ থাকে তার প্রতিদিন। একজন সঙ্গীত শিক্ষক সপ্তাহে দুবার তাকে গান শেখাতে বাড়িতে আসেন। আর অন্যান্য দিনগুলিতে সে নিজে ক্লাসে হাজিরা দেয়। একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাত ৮টার মধ্যে সে বাড়িতে ফিরে আসে। তারপরে সে একে একে সাইকেল চালাতে এবং হাঁটাহাঁটি করতে যায়। সে তার সমস্ত দৈনন্দিন কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী বেঁধে রেখেছে। এমনকি নিজে কী পরবে না পরবে সে সম্পর্কেও সে বিশেষভাবে সচেতন। সে বাধ্য ছেলের মতো আমাদের ইজিএস প্রতিবেদকের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এমনকি সেই মেয়েটির জন্য একটা গোটা গানও গেয়ে ফেলেছে: ১৯৭২ সালের চলচ্চিত্র "মেরে জীবন সাথী" থেকে কিশোর কুমারের গাওয়া "ও মেরে দিল কে চ্যায়েন"। সে বলেছে, "লাল আমার প্রিয় রং। বর্ষাকাল আমার সবচেয়ে পছন্দের। আর আমি আমার মায়ের হাতের পনিরের তরকারি খেতে খুব ভালবাসি। একাডেমির রাজ [একজন ক্রীড়াবিদ] আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”
সঞ্জীবের কথা অনুসারে, শিবেশের প্রতি অনিতা নিজের একশ শতাংশ উৎসর্গ করে দিয়েছে: "যদি ওর মন্দিরে যাওয়ার থাকে, আবার একই সঙ্গে তখন শিবেশের কোনও অনুষ্ঠান থাকে তবে অনিতা সবসময় ছেলেকে নিয়ে ওই অনুষ্ঠানেই যেতে পছন্দ করবে।" অনিতা জানিয়েছেন, শিবেশ হিন্দি ছবির গান থেকে শুরু করে ভক্তিমূলক গান সবই গাইতে পারে। "আমার একমাত্র ইচ্ছা ওর প্রতিভা যেন বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করে," তিনি আরও যোগ করেন। "ও আমাদের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদতুল্য। আমরা ওকে নিয়ে এবং ওর সাফল্যে খুবই গর্বিত। আমরা প্রতিটি পদক্ষেপে ওর পাশে থাকব।”