Icon to view photos in full screen

"আমি ছোটবেলা থেকেই গান করি। আপনি আমাকে যে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন, আমি আমার দলের সঙ্গে গিয়ে গান গাইব”

৩৬ বছর আগে যখন অমৃতসরের রাকেশ ভাটারার (৬৫) গর্ভে তাঁর দ্বিতীয় ছেলে সমীর এসেছিল, তিনি তখন স্বামী অশ্বিনের সঙ্গে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গিয়েছিলেন। যে ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছিলেন তিনি সুনির্দিষ্টভাবে না হলেও তাঁদের এটুকু নিশ্চিতভাবে বলেছিলেন যে আসন্ন শিশুটির কোনও একটি শারীরিক অক্ষমতা থাকবে, অতএব গর্ভপাত করে নেওয়াই শ্রেয়। (যদি জন্মের আগের কোনও পরীক্ষায় দেখা যায় যে শিশুটি 'গুরুতরভাবে প্রতিবন্ধী' হয়ে জন্মাবে, সেক্ষেত্রে ভারতীয় আইনে গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হয়।)

অশ্বিন অবশ্য সেই সময় রাকেশের চেয়েও বেশি দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। “এটা আমার সন্তান,” জোরের সঙ্গে এই কথা বলে অশ্বিন বললেন, “আমি কিছুতেই গর্ভপাতের অনুমতি দেব না।” ঘটনাচক্রে সমীর কিছু বৌদ্ধিক অক্ষমতা নিয়েই জন্মাল। তবে অশ্বিন তাকে খুবই ভালোবাসতেন। “আমার স্বামী ২১বছর আগে যকৃতে জন্ডিস হয়ে মারা গিয়েছেন,” রাকেশ অশ্বিনকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেন। “উনি বলতেন সমীর আমাদের ঈশ্বরদত্ত ধন। আমাদের ওকে যথাযথভাবে লালন করা উচিত, ও যাতে জীবনে সবচেয়ে সেরা সুযোগসুবিধাগুলো পায় সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য।” অশ্বিনের এই জীবনদায়ী, জীবন-পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তই এই বিশ্বকে এমন প্রাণোচ্ছ্বল, উদ্দীপনাপূর্ণ এক প্রতিভাবান মানুষ উপহার দিয়েছে!

রাকেশ আমাদের ইজিএস সাক্ষাৎকারগ্রাহককে ফোনে বলেন, “আমাদের দুজনের একটা ছোট্ট, সুখী জগত আছে। সমীরও খুব উৎসাহ নিয়ে নিজের সম্পর্কে বলেছেন: “আমি গান গাইতে ভালবাসি। আড়াই বছর বয়স থেকেই আমি গান গাইছি। আমি শুরুটা করেছিলাম গুরু গ্রন্থ সাহেব থেকে কীর্তন গাওয়া দিয়ে। পরে আস্তে আস্তে অন্যান্য গানে চলে যাই। এখন আমি পেশাদারভাবেও গান করি, বহু মঞ্চে গেয়েছি। আমার ইউটিউব পেজে গেলে আপনারা এরকম বেশ কিছু অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন। ( [ @sameerbhatara<https://www.youtube.com/@sameerbhatara9564>) )। আমার এক দাদাও আছে, সুশীল। আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। তিনি সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। আমরা মার্চ মাসে ওদের সঙ্গে দেখা করতে ওখানে যাব।”

রাকেশ স্পষ্ট করে জানালেন, "আড়াই বছর" কথাটা মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। সমীরের এত ভাল স্মৃতিশক্তি এবং প্রখর শ্রবণক্ষমতা যে গুরুদ্বারে গাওয়া কীর্তন শুনে শুনেই সে আপন অন্তর দিয়ে শিখদের এই পবিত্র গ্রন্থটি একদম রপ্ত করে নিয়েছিল, যদিও সে লিখতে বা পড়তে পারে না। যেহেতু সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বা শিক্ষাসূচীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমীরের একটু সমস্যা হয়েছিল, তাই একটার পর একটা স্কুল তাকে ছেড়ে দিয়েছে ("কখনও কখনও আমি দ্বিগুণ ফি-ও দিয়েছি, এই আশায় যে হয়তো ওরা আমার ছেলেটাকে এবার রেখে দেবে")। ওর ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত এভাবেই চলেছে, তারপর রাকেশ ছেলের স্কুলে পড়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গানটা যেহেতু তার মজ্জাগত ব্যাপার ছিল, তাই যে কোনও সুযোগ পেলেই ছেলেকে মঞ্চে উঠতে উৎসাহিত করেছেন রাকেশ।

অশ্বিন যখন মারা যান যখন তাঁর ছেলেরা সদ্য কৈশোরে, রাকেশ একা হাতে তাদের বড় করেছেন। “আমরা দুজনেই বেশ বড় পরিবার থেকে এসেছি কিন্তু তাঁদের কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। আমি আমার স্বামীর কাপড়ের কারখানার মেশিনগুলো বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে কয়েকটা ঘর বানিয়েছিলাম, সেগুলো ভাড়া দিয়ে ওই অর্থে আমি আমার সন্তানদের দেখাশোনা করেছি। সুশীল রোজগার করতে শুরু করার পর সে আমাকে অনেকটা সাহায্য করেছে। বছর কুড়ি বয়সের পর ও বিয়ে করে। গত বছর জানুয়ারিতে ওদের একটি সন্তানেরও জন্ম হয়েছে! আমরা জন্মের পর বাচ্চাটাকে দেখতে গিয়েছিলাম, সামনের মাসে আবার যাব।”

যেহেতু সমীরের ঠিকঠাক অঙ্গ সঞ্চালনের বিষয়ে সামান্য প্রতিবন্ধকতা আছে, বিশেষত সে হাত দিয়ে কোনও সূক্ষ্ম কাজ করতে গেলে তাতে নৈপুণ্যের অভাব থেকে যায়, তাই রাকেশ তাকে পোশাক পরার সময় জামাকাপড়ের বোতাম লাগানোর মতো কাজগুলোতে সাহায্য করে। যদিও সে নিজেই বেশিরভাগ কাজ করতে চেষ্টা করে। "লোকে যখন ওর সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করে, তখন আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়। আগে আমি এসবে ভীষণ আঘাত পেতাম, তবে আজকাল আর পাত্তা দিই না। কিন্তু এই খারাপ লাগা কাটাতে আমার খানিকটা সময় তো লেগেছেই।” এ কথা বলার সময় রাকেশের গলা কান্নায় বুজে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ফের বলেন: “আমি সমীরকে বলেছি একদম চিন্তা করবি না, মনে রাখিস আমরা একটা দল। আমার একটাই ইচ্ছা, ও ​​যেন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।”

তাজা মুক্ত শ্বাসবায়ুর মতো এনজিও 'আগোশ হোল্ডিং হ্যান্ডস' তাদের জীবনে এসে হাজির হয়েছিল। সমীর এবং আগোশের প্রতিষ্ঠাতা মনিন্দর কৌরের মেয়ে একটি বিশেষ স্কুলে একসঙ্গেই পড়ত। লোকেরা স্কুলে যেসব খেলনা, খাবার-দাবার, মনিহারি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র উপহার দিত, সেখানকার অধ্যক্ষ সেগুলো জড়ো করে শিশুদের কাছে বিক্রি করে সেই টাকা পকেটস্থ করতেন! রাকেশ বলেন, “আমরা বিরক্ত হয়ে গেছিলাম এসব জেনে। তাই আমরা একে অপরকে বলতাম, ‘তোমরা নিজেরা একটা স্কুল শুরু করছ না কেন?’ মনিন্দরই অবশেষে উদ্যোগ নিয়েছিল,” রাকেশ বলে। “আমি আর সমীর প্রতিদিন আগোশে যাই। ও বাচ্চাদের গান গাইতে আর হারমোনিয়াম বাজাতেও শেখায়। আমি ওখানকার বাচ্চাদের সঙ্গে আমার ছেলেদের আর নাতির জন্মদিন উদযাপন করি।”

বিকাল ৫টায় বাড়ি ফেরার পর সমীর টিভিতে "তারক মেহতা কা উল্টা চশমা" দেখতে আর নিজের ফোনে গেম খেলতে পছন্দ করে। বাড়িতে রান্না করা খাবারেরই ভক্ত সে। বিশেষ করে মাশরুম, পনির ভুজ্জি এবং মেথিশাক খেতে ভালবাসে। রাকেশ বলেন, “ও ঘরেও আমায় সমানে গান শুনিয়ে যায়।" এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে তার প্রিয় গানগুলো সে মাকেই উৎসর্গ করে।

"আমি আপনাদের জন্যেও গান গাইব!" "রং দে বাসন্তী" চলচ্চিত্রের "লুকা ছুপি" (একজন মা তার ছেলেকে খুঁজছেন, সেই গান) গানটা গাওয়ার আগে সমীর আমাদের সাক্ষাত্কারগ্রাহককে চিৎকার করে এই কথাটা বলেছিল। গান গাওয়া যখন শেষ হল, সাক্ষাৎকার নেওয়া মেয়েটির চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে। সে বেঙ্গালুরু নিবাসিনী জেনে সমীর শেষে বলল, “যদি কখনও বেঙ্গালুরুতে কোনো অনুষ্ঠান হয়, আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে ভুলবেন না। আমি আমার দলের সঙ্গে গিয়ে ওখানে গান গাইতে চাই, এবং এটাও বলছি, আমি আপনাদের থেকে এক পয়সাও নেব না!”

ছবি:

ভিকি রয়