ময়না পাখি মানুষের গলা নকল করতে পারে—এই কারণে অনেকেই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু এই পাখিটিকে কথা বলা শেখানোর চেষ্টা করছে দুই ভাই—সাবির আহমেদ (১৭) ও সামিম আহমেদ (১৫)। আশ্চর্যের কথা হলো, ওরা দু’জনেই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী, কিন্তু তাও থেমে নেই। ওদের মা পারিতুন্নিসা (৪২) হাসতে হাসতে বলেন, “ওরা সাংকেতিক ভাষা দিয়ে ময়নাকে কথা বলা শেখানোর চেষ্টা করে!”
“ওরা ঠোঁট নেড়ে দেখায় কিভাবে কথা বলতে হয়,” বলেন পারিতুনিসা। “কি ভালোবাসা! কি ধৈর্য!”
আসামের কাছাড় জেলার গোরা গ্রামে থাকে সাতজনের এই পরিবার। “সাবির ছিল চার আর সামিমের আড়াই বছর বয়স—আমি লক্ষ্য করি, ওরা কোনো আওয়াজে সাড়া দেয় না, কোনো কথা বলে না,” বলেন পারিতুন। ডাক্তার দেখাতে ওদের নিয়ে যাওয়া হয় শিলচরের সরকারি হাসপাতালে। সেখানে শ্রবণযন্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু যন্ত্র পরার পর ওদের কান লাল হয়ে যেত, ফুলে যেত, যন্ত্রণা হতো। ফলে ওদের শ্রবণ যন্ত্র ব্যবহার বন্ধ করে দিই। (মনে হয়, কোনো সঠিক থেরাপি বা যন্ত্র ব্যবহারের উপযুক্ত নির্দেশও ওদের দেওয়া হয়নি।)
পারিতুনের স্বামী সাহাবুদ্দিন চৌধুরী (৪৩) একজন হকার, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঙা ধাতব জিনিস কেনাবেচা করেন। বড় ছেলে নাসিরউদ্দিন (২১) একজন রাজমিস্ত্রি। মেয়ে স্বপ্না বেগম (১৯) পড়াশোনা শেষ করে এখন আগামী বছর বিয়ের প্রস্তুতির অপেক্ষায়। ছোট মেয়ে সানা বেগম (১৩) স্কুলে পড়ে। পারিতুন গৃহস্থালির পাশাপাশি বেতের চাটাই বোনেন— যা স্বপ্না নিপুণভাবে রপ্ত করেছে এবং সামিমও খুব তাড়াতাড়ি শিখছে।
সাবির আর সামিম নিজেরাই নিজস্ব এক প্রাণবন্ত ও অভিব্যক্তিপূর্ণ সাংকেতিক ভাষা তৈরি করেছে, যা তাদের পরিবারের সবার কাছে আজ অনন্য। চায়ের ইচ্ছা হলে ওরা আঙুল দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে আর অন্য হাতে নাড়ার ভঙ্গি করে। স্নানের ইঙ্গিত দিতে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে জল ঢালার ভান করে।
“শুরুর দিকে বুঝতে একটু কষ্ট হতো,” বলছেন পারিতুন। “কিন্তু মা হিসেবে আমি আগেই বুঝে যেতাম ওদের কী দরকার। আমি ওদের ভাষা শিখে আমার স্বামী ও বাকি ছেলেমেয়েদেরও শেখালাম। ধীরে ধীরে আমাদের পুরো পরিবার নিঃশব্দ এক ভাষায় কথা বলা শুরু করল।”
ওরা পড়াশোনায় খুব উৎসাহী ছিল এবং ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ভালো করেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে যায় যখন হাই স্কুলের প্রিন্সিপাল ওদের ভর্তি নিতে অস্বীকার করেন। “এটা সাধারণ ছেলেমেয়েদের স্কুল,” তিনি বলেন। “আমাদের এখানে মূক-বধিরদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।”
দুই বছর ধরে পারিতুন চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু কিছুই হয়নি। “সামিম তো ভর্তি পরীক্ষায় ভালো নম্বরও পেয়েছিল,” চোখের কোণ ভিজে আসে পারিতুনের। “ওদের যদি একটু সুযোগ দেওয়া হতো, ওরা নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে পারত।” ওদের বাড়ি থেকে প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়টা এত দূরে ছিল যে নিয়মিত যাওয়া সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে ওরা নিজস্ব উপায়ে শেখা শুরু করে।
সাবির আর সামিমের পৃথিবী ঘিরে আছে পশু ও পাখি। ওরা ছাগল, হাঁস, মুরগি আর পাখিদের খুব ভালোবাসে। নিজের জমানো টাকায় বাজার থেকে এসব কিনে আনে। ইউটিউবে পোষা প্রাণীদের যত্ন নেওয়ার ভিডিও দেখে শেখে। ওদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—একটা খামার করা, যেখানে পশুপাখি পালন করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো যাবে।
“ওদের অনেক স্বপ্ন,” বলছে বড় ভাই নাসিরউদ্দিন। “ওরা নিজেদের প্রতিবন্ধকতাকে অক্ষমতা ভাবে না—বরং সম্ভাবনা ভাবে।”
নাসির আর পারিতুন ওদের মাঝে মাঝে হাত খরচ দেন। সাবির একটু খরচাপাতি বেশি করে—ছোট বোন সানার জন্য মাঝেমধ্যে টুকটাক জিনিস কিনে আনে। সামিম বরং টাকাটা জমিয়ে রাখে—ভবিষ্যতের কথা ভেবে। “ওরা বলে আমি নাকি ওদের স্বপ্নপূরণ করি,” গর্বে বলেন নাসির। “ঈদে আমি ওদের স্মার্ট ওয়াচ উপহার দিয়েছিলাম। ওদের মুখে যে হাসি দেখেছিলাম—অমূল্য!”
উৎসব মানেই আনন্দ ওদের জন্য—আর ঈদ তো প্রিয় উৎসব। “সব প্রস্তুতিতে ওরা সাহায্য করে,” বলেন ওদের মা। “পিঠা, সেমাই, পাপড় তৈরি থেকে শুরু করে বাড়ি সাজানো পর্যন্ত—সব কিছুতেই আগ্রহ।” নারিকেল পিঠা, চাল গুঁড়া, নারিকেল আর মধু দিয়ে তৈরি এক অসমীয় মিষ্টি, ওদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
ওরা গ্রামের পুকুরে মাছ ধরতেও খুব ভালোবাসে। যদিও নিরাপত্তার কারণে বড় জমায়েতে ওদের যেতে দেওয়া হয় না, তবুও বাড়িতেই গভীর ভক্তিভাবে নামাজ পড়ে। “ওরা প্রার্থনার শব্দ শুনতে পায় না, কিন্তু বিশ্বাসটাকে অনুভব করে,” বলেন নাসির। ওদের আরেকটা প্রিয় উৎসব—শব-এ-বরাত। সেই রাতে ওরা মসজিদ ও বাড়ির চারপাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে সাজিয়ে তোলে।
“ওরা আমার গর্ব,” বলেন পারিতুন। “অনেকে ভাবে ওরা ভিন্ন ধরণের, কিন্তু আমার চোখে ওরা অন্য বাচ্চাদের মতোই একদম সম্পূর্ণ।”