Icon to view photos in full screen

“বড় হয়ে ওঠার সময় আমি কোনও ঘরের কাজ করিনি। আমার মা-ই আমার জন্য সবকিছু করেছেন"

ছত্তিশগড়ের জে ভি পি এ এস-এর মনোজ জাংড়ে যখন ভিকি রায়কে রাজকুমারী কুর্রের (৪৪) কিছু ছবি তোলার জন্য সঙ্গে নিলেন, তখন রাজকুমারী তাঁর বোনপো আনমোল (১১) আর আয়ুশ (৭) এবং বোনঝি পায়েলের (১০) সঙ্গে বিলাসপুরে তাঁর বোন পূজার শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। রাজকুমারী এবং তাঁর স্বামী রামসুরত (৪০) উভয়েই শৈশবে জলবসন্তে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হওয়ার ফলে ১০০ শতাংশ অন্ধত্বের শিকার হয়েছিলেন। দিল্লিনিবাসি এই দম্পতির বিয়ে হয় ২০১৫ সালে।
রাজকুমারীর বাবা বসন্তলাল কুর্রে ছিলেন বিলাসপুরের একজন রাজমিস্ত্রি। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী রামবাই তাঁদের চার মেয়ে ও দুই ছেলেকে লালন-পালন করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেছিলেন। রাজকুমারী স্কুলে যাননি, তবে গির্জার একজন ধর্মযাজক, “ড্যানিয়েল-স্যার”, তাঁকে পড়াশোনা শেখানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর একজন অন্ধ শিক্ষক তাঁকে ছয় মাস ধরে ব্রেইল পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন এবং তাঁর জন্ম শংসাপত্র পেতেও সাহায্য করেছিলেন। তিনি মুক্ত বিদ্যালয় ব্যবস্থা এন আই ও এস-এর মাধ্যমে পঞ্চম, অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় বসে তারপর একটি সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজের দ্বিতীয় বছরে তাঁর মা রামবাই এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় তাঁর পড়াশোনা সাময়িক ব্যাহত হয়। কিন্তু পরে তিনি নিজের স্নাতক স্তরের পড়া সম্পন্ন করে ফেলেন।
কখনও কখনও, একটি অত্যধিক রক্ষণশীল পরিবার তাঁদের অতিরিক্ত আগলে রাখার মানসিকতার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে। রাজকুমারী কখনওই নিজের ইচ্ছেমত চলাফেরার অধিকার অর্জন করতে পারেননি। কারণ সবসময়েই তিনি যেখানে যেতে চাইতেন, তাঁর মা অথবা ভাইবোনেরা তাঁকে সেখানে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। “আমি কখনওই বাড়িতে নিজে কোনও কাজকর্ম করিনি কারণ আমার মা সর্বদা আমাকে সাহায্য করার জন্য বসে থাকতেন,” তিনি বললেন। তিনি গান গাইতে ভালবাসতেন বলে এন আই ও এস-এ গণিতের পরিবর্তে সঙ্গীতকেই বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। রামবাই তাঁকে একজন সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে নিয়ে যেতেন কিন্তু তাঁর দুর্ঘটনার পর সেই পাট চুকে যায়। আসলে, রামবাইয়ের ভয় ছিল “আমি না থাকলে কে তোর দেখাশোনা করবে?” যা রাজকুমারীকে বিয়ের কথা ভাবতে বাধ্য করে। তাঁর বন্ধু শকুন্তলা, যিনি হুইলচেয়ারে চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলেন, তিনিই বিয়েতে ঘটকের কাজটা করেন।
রামসুরত ইউপির একটি পরিবারের সাত ভাইবোনের একজন। তিনি গোরক্ষপুরে পড়াশোনা করলেও স্নাতক স্তর শেষ করতে পারেননি। তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে নিজের শহর থেকে দিল্লি যেতেন। সেই বন্ধু ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ব্লাইন্ড (রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিহীন সংস্থা) দ্বারা পরিচালিত দৃষ্টিহীনদের জন্য নির্ধারিত একটি আবাসে থাকতেন। রামসুরত বন্ধুর বিয়েতে বিলাসপুরে গিয়েছিলেন এবং সেই বন্ধুর কনেই ছিলেন শকুন্তলা। সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য সরকারের গণবিবাহ প্রকল্পের মাধ্যমেই তাঁদের গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছিল। বিয়ের সময় শকুন্তলা ইচ্ছাকৃতভাবেই রামসুরতকে অনুরোধ করেন তিনি যেন ফেরার সময় তাঁর বান্ধবী রাজকুমারীকে তাঁর বাড়িতে একটু পৌঁছে দেন। রাজকুমারীর বাবা-মায়ের তখনই রামসুরতকে ভাল লেগে যায়।
বিয়ের পর, শকুন্তলা রাজকুমারীকে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি করার জন্য দিল্লিতে নিয়ে আসেন। এদিকে, বিলাসপুরে কিছুদিন পরেই আরেকটি গণবিবাহের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। রাজকুমারী তখন মা রামবাইয়ের পীড়াপীড়িতে, সেখানে বিয়ের জন্য আবেদনপত্র পূরণ করে রামসুরতকে সেটা জানিয়ে দিলেন। তিনি তাঁকে বললেন যে তাঁর বাবা-মা রামসুরতকে পছন্দ করেন। এখন তিনিও কি তাহলে একটি আবেদনপত্র জমা করতে আগ্রহী হবেন? রামসুরত রাজি ছিলেন বলাই বাহুল্য, এবং যথারীতি বিলাসপুরে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। যদিও দিল্লিতে ফিরে আসার পরে, রাজকুমারী আর সেই কম্পিউটার কোর্স করার সুযোগ পাননি।
রামসুরত বেকার। অগত্যা সোজা কথায় “অনুদান”-এর টাকাতেই এই দম্পতির দিন চলে। তাঁরা প্রতিদিন দোকান, বাজার, মেট্রো স্টেশনের মতো জনবহুল জায়গায় অর্থসাহায্য চাইতে বের হন। তাঁদের পরিবারও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার মতো যথেষ্ট সচ্ছল নয়। রাজকুমারীর বাবা-মা আর জীবিত নেই, তাঁর বোনেরা সবাই বিবাহিত এবং তাঁর ভাইয়েরা চাকরিরত - যেমন তাঁর বড় দাদা সরকারি চাকরি করেন আর তাঁর স্ত্রী একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। আর তাঁর ছোট ভাই একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে রাজকুমারীর সুসম্পর্ক রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে তিনি মাঝে মাঝেই উত্তরপ্রদেশে যান।
রাজকুমারী সবসময় তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে না পারা এক্ষেত্রে অন্তরায় হয়েছে বরাবর। “কে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে?” এই প্রশ্নটা আমরা বারংবার তাঁর মুখ থেকে শুনতে পেয়েছি। “এখন আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা যেন আমার স্বামী একটি চাকরি পান, যাতে আমাদের আর বাইরে গিয়ে লোকদের কাছে হাত পাততে না হয়,” তাঁর অকপট বক্তব্য। বস্তুত তিনি নিজেও সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সটা এখনও করতে চান কিন্তু সেটার খরচ বহন করা তাঁদের পক্ষে দুঃসাধ্য। মোদ্দা কথা, আরও ভালো কিছু করার ইচ্ছা তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান!

ছবি:

ভিকি রয়