একজন সরকারি স্কুল শিক্ষকের বিয়েতে অতিথি হিসেবে অসংখ্য ভিআইপি এবং প্রাক্তন মহারাজের সামিল হওয়াটা কিছুটা বিরলই বটে। তবে এক্ষেত্রে প্রকাশ চাঁদ খিচি’র কাহিনি কিছুটা আলাদাই। এক অন্ধ লোক আর তার দৃষ্টিশক্তি থাকা প্রেয়সীর আন্তঃরাষ্ট্রীয় অভিনব প্রেমকাহিনি যোধপুরের জনসাধারণের মনোযোগ কেড়েছিল।
প্রকাশ (৪২) রাজস্থানের আসোপ গ্রামের বাসিন্দা। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ প্রকাশ চিকিৎসা-না-হওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণে দু’বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান। যোধপুরের নেত্রহীন বিকাশ সংস্থান পরিচালিত দৃষ্টিহীনদের স্কুলে তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। তারপরে দিল্লিতে দশম শ্রেণীর পাঠ শেষ করার জন্য তাকে রাজস্থান-সরকার-প্রকল্পের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
হাইস্কুলের পরে গরমের ছুটিতে প্রকাশ আবিষ্কার করেছিলেন, সিরোহি বাস-স্ট্যান্ডে বই বিক্রি করে— কৌতুক ও সাধারণ জ্ঞানের বই যেগুলো সচরাচর ফেরিওয়ালারা বিক্রি করে— তিনি দিনে দু’শো টাকা পকেটে ভরতে পারবেন। পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক না হওয়া অবধি তিনি বাস-স্ট্যান্ডে বই বিক্রি করা চালিয়ে যান, পরে ফলের রসের দোকান ও এসটিডি বুথ বানিয়ে নিজের রোজগার বাড়িয়ে ফেলেন। স্নাতকোত্তরের পরে তিনি একটি শিক্ষক-প্রশিক্ষণের কোর্স করেন, তবে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হন। কারণ একটি শ্রেণী পরিচালনার জন্য একজন অন্ধ ব্যক্তি অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল। আদালতে তিনি এই বিষয়ে যুক্তিবলে বিবাদ করেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে দুই বছরের লড়াইয়ে জয়ী হন।
প্রকাশের সুন্দর বাচনভঙ্গি, আন্তরিকতা ও নম্র ব্যবহার মহারাষ্ট্রের (অমরাবতী) কবিতা মহাদেবকে মুগ্ধ করেছিল, যিনি মাউন্ট আবুতে নিজের বোনের কাছে আসার সময় প্রকাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হয়। ২০০৫-এর ১৯শে মে দিনটি ছিল প্রকাশের কাছে দ্বিগুণ স্মরণীয় : এই প্রথম শিক্ষক-নিয়োগপত্রটি তিনি পেয়েছিলেন এবং সেদিনই বিয়ের জন্য কবিতার হাত চাইতে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে অমরাবতীর দিকের ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কবিতার বাবা-মা এককথায় নারাজ। কীভাবে তারা তাদের শিক্ষিত ২১ বছরের মেয়েকে এক অন্ধের সঙ্গে জীবনব্যাপী ‘শাস্তি’ পেতে দেবেন?
কবিতা অনড় ছিলেন : “আমি কেবল ওঁকেই বিয়ে করব।” বাবা-মায়ের সম্মতির জন্য তাকে দু’বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই দম্পতি ২০০৭-এর ১৯শে ফেব্রুয়ারি ডটলাইনে স্বাক্ষর করে তার নয়দিন পরে ধুমধাম করে রাজস্থানী বিয়ে সম্পন্ন করেন। বৃষ্টি হয়েছিল— রাজ্যে এটি বিরল ঘটনা— এবং একটি স্থানীয় পত্রিকায় খবর বের হয় যে, আবহাওয়াও যেন সেদিন এই পরিণয়ে আনন্দমুখরিত ছিল! বিয়েতে ১৫০০ অতিথির সম্পূর্ণ খরচ নিজে বহন করার দায়িত্ব নেয় প্রকাশ।
২০১৩ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এবং ২০১৭-তে অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি হয়েছিল প্রকাশের। “অবসরের পরে আমি জেলা-শিক্ষা-আধিকারিক হয়ে যাব,” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলেন। কবিতার নিঃস্বার্থ সমর্থন এবং তার ডাল, ভাটি, চুরমা আর পালং-পনিরের সম্পর্কে বলতে তিনি কখনো ক্লান্ত হন না। তিন সন্তান, বেশ ভালো উপার্জন এবং নিজের দোতলা বাড়ি নিয়ে প্রকাশ বলেন, এর থেকে সুখী আর কোনও সংসারী মানুষ আপনি খুঁজে পাবেন না।