একজন যত্নশীল ছোট বোন পাওয়া কোনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আন্দামানের প্রাচি টোপ্পো (১৯)-এর চেয়ে এটা কে-ই বা বেশি ভালো করে জানে? তার দুই বছরের ছোট বোন গীতিকা, তার সঙ্গে একই মূলধারার স্কুলে পড়ত এবং পরে তারা একই ক্লাসে সহপাঠীও হয়ে যায়। প্রাচির উপর গীতিকার সজাগ দৃষ্টি থাকত, শিশুবয়সেই প্রাচির সেরিব্রাল পালসি (CP) ধরা পড়েছিল। এর ফলে তার যে কোনও মুহূর্তে ফিট (খিঁচুনি) হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল।
তারা পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মথুরা গ্রামে তাদের মা বাসন্তী তিরকে (৪৪)-র সঙ্গে থাকে। তাদের বাবা ভূখান টোপ্পো একজন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, বর্তমানে তামিলনাড়ুর মাদুরাইতে পাবলিক ওয়ার্কস বিভাগে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। ভূখানের মা তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকেন। বাসন্তীর কথায় তাঁর মেয়েরা যখন ছোট ছিল তখন তাদের দেখাশোনা করার ব্যাপারে তাঁর শাশুড়ি প্রভূত সাহায্য করেছিলেন।
বাসন্তী স্কুলের অধ্যক্ষের কাছ থেকে প্রায়শই অভিযোগ পেতেন যে প্রাচি ক্লাসে অস্থির হয়ে যায় এবং অন্য বাচ্চাদের বিরক্ত করে। গীতিকা তার দিদিকে শান্ত করত। স্কুল প্রাচিকে উচ্চতর শ্রেণীতে উন্নীত করতে থাকে। এইভাবে সে দশম শ্রেণীতে পৌঁছে যায়। তাকে তার বোর্ড পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একজন নবম শ্রেণির ছাত্রীকে অনুলেখক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। প্রাচি উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জন্য কলা এবং গীতিকা বিজ্ঞানকে তাদের বিষয় হিসাবে নিয়েছিল। তারা একসঙ্গেই দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়। বাসন্তী বলেন যে প্রাচি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খিঁচুনির ব্যাপারটা ওষুধের সাহায্যে কমে গেছে, তার বাম হাতে সামান্য দুর্বলতা ছাড়া তার বাচন এবং চলাফেরাতেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
এম ভবানীর মুখোমুখি হওয়ার পর প্রাচির জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে যায়। তিনি একজন পদকপ্রাপ্ত প্যারা অ্যাথলিট যাঁকে আমরা EGS-এর পাতায় তুলে ধরেছি। তিনি বহু প্রতিবন্ধী শিশুদের খেলাধুলার দিকে পরিচালিত করার কান্ডারি। ভবানী বাসন্তীকে আমন্ত্রণ জানান প্রাচিকে স্টেডিয়ামে নিয়ে আসতে। যেখানে অন্যান্য অনেক প্রতিবন্ধী শিশু বিভিন্ন খেলাধুলায় নিযুক্ত। তাদের দেখে, এবং পরে তাদের সঙ্গে ভলিবলের মতো খেলায় অংশ নিয়ে প্রাচি খেলাধুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এবং তার মাকে বল এবং অন্যান্য খেলার সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য করে। প্রাচিকে অনুশীলনের জন্য স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়াটা বাসন্তীর রোজকার রুটিনে পরিণত হয়েছিল। "এখন বর্ষাকাল, কিন্তু আবহাওয়া অনুকূল হওয়ার পর আমরা আবার এটা চালিয়ে যাব," বাসন্তী আমাদের বললেন।
প্রাচি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে পুনেতে ২১তম জাতীয় প্যারা অ্যাথলেটিক গেমসে অংশ নিয়েছিল। যদিও ভবানী এবং অন্য একজন কোচ প্রাচি এবং অন্য চারজন সতীর্থের সঙ্গেই ছিলেন, তবু বাসন্তী তার সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাদের এই সফরের খরচ নিজেদেরই বহন করতে হয়েছিল, কিন্তু যখন প্রাচি শটপুটে একটি স্বর্ণপদক এবং দৌড় প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করল, তখন তারা এর পুরস্কারটা পেল। ২০২৩-এর ডিসেম্বরে দিল্লিতে খেলো ইন্ডিয়া প্যারা গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় প্রাচির নাম অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় ছিল, এবার আন্দামান সরকার তার যাবতীয় খরচ বহন করলেন। "আন্দামানে আমরা এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় অভ্যস্ত নই!" বাসন্তী বললেন। “প্রাচীর শটপুট ইভেন্ট ছিল বিকেল ৫টায়। ঠান্ডায় তার স্বাভাবিক দক্ষতা প্রভাবিত হয়েছিল, কিন্তু তারপরও সে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিল।”
প্রাচি ছবি আঁকতে, টিভি দেখতে এবং মোবাইল ফোন নিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাতে পছন্দ করে। সে তার দৈনন্দিন সব কাজ নিজেই করে। বাসন্তী তাকে উনুন জ্বালাতে দিতে ভয় পান, কিন্তু যখন তার প্রিয় ডিম সেদ্ধ খেতে ইচ্ছে করে তখন সে নিজেই সেটা বানিয়ে নেয়। সে রেস্তোরাঁয় খাবার অর্ডার করতে পছন্দ করে, প্রধানত নিরামিষ ফাস্ট ফুড; যদিও নিত্যনতুন পদ চেখে দেখার জন্য সে মুখিয়ে থাকে।
বাসন্তী এবং ভূখান তাকে সারা বিশ্বের দরবারে মুখোমুখি করার জন্য প্রস্তুত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বাসন্তী গর্ব করে বলেন যে তিনি প্রাচির হাতে টাকা দিয়ে তাকে কাছের দোকান থেকে জিনিস কিনতে পাঠান, যাতে সে মনে মনে হিসেবের অঙ্কটা কষে ফেলতে পারে। একটি জিনিসের দাম কত এবং দোকানদারকে কত টাকা ফেরত দিতে হবে, সবটাই। তিনি প্রাচির হাতে অল্প অল্প পরিমাণে টাকাও দেন যা সে তার নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করতে শিখেছে। সে এটিএম থেকে কীভাবে নগদ তুলতে হয় তাও শিখে নিয়েছে।
বাসন্তী তাঁর মেয়েকে পোর্ট ব্লেয়ারের ব্রুক্ষাবাদে কম্পোজিট রিজিওনাল সেন্টার ফর স্কিল ডেভেলপমেন্ট, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অফ পার্সনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ (CRC) –তে নথিভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন। বর্তমানে সে সরকার থেকে প্রতি মাসে ₹২৫০০ টাকা পায়, কিন্তু তার মা-বাবা তার জন্য একটি সরকারি চাকরির প্রত্যাশায় রয়েছেন। যাতে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হয়।