অতিসক্রিয়তায় ভোগা শিশুদের সামলানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত হওয়াটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন! যেমন অমৃতসরের এক প্রাক্তন শিক্ষিকা আরতি মেহরা (৪৮) এবং তাঁর ব্যবসায়ী স্বামী ঋষি মেহরা (৫১)। দুই দশক আগে যখন তাঁদের অটিজমে আক্রান্ত প্রথমা সন্তান, নিয়তির জন্য একটা উপযুক্ত স্কুলের সন্ধান করছিলেন, সেই সময় এই যন্ত্রণাদায়ক সত্যিটা তাঁরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলেন।
ডিএভি পাবলিক স্কুল, যেখানে তাঁরা প্রাথমিকভাবে নিয়তিকে ভর্তি করেছিলেন, সেখানে বিশেষ শিক্ষার জন্য শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু যখন সেই স্কুল পরিচালন সমিতির হাত বদল হয়, তখন নতুন অধ্যক্ষ মনে করলেন যে বিশেষ শিক্ষার ব্যাপারটা স্রেফ একটি অপ্রয়োজনীয় আর্থিক বোঝা। যথারীতি সাধারণ শিক্ষকরা নিয়তির বিশেষ চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। উল্টে তাঁরা অভিযোগ করতে শুরু করলেন যে ক্লাসে ও ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। তার বাবা-মা অগত্যা উপযুক্ত স্কুলের জন্য অমৃতসরে হন্যে হয়ে সন্ধান শুরু করলেন, কিন্তু হতাশ হয়ে দেখলেন যে কোথাও বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।
আরতি তখন নিয়তিকে এমন একটা মূলধারার স্কুলে ভর্তি করলেন যেখানে তিনি নিজেই ছিলেন একজন শিক্ষিকা। সেখানে আবার এমন একজন বয়স্ক অতিরিক্ত শৃঙ্খলাপরায়ন শিক্ষক ছিলেন, যিনি চঞ্চল শিশুদের চেয়ারে হাত বেঁধে আটকে রাখতেন! নিজের ক্লাসে পড়ানোর সময় প্রায়ই আরতি নিয়তির চিৎকার শুনতে পেতেন। তাকে এই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার পর মেহরা দম্পতি আর একটি নতুন স্কুলে তাকে ভর্তি করেন। এই স্কুল কর্তৃপক্ষ নিয়তির বিশেষ চাহিদা মেটানোর অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তাঁরা শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিলেন যে স্কুলটি তাকে ভর্তি করেছে শুধুমাত্র তাদের ছাত্রসংখ্যা বাড়ানোর তাগিদে, তার প্রতি মনোযোগ দিতে ওরা মোটেই আগ্রহী ছিল না।
স্প্রিং ডেল স্কুল যখন প্রেরণা খান্নার (যাঁর কথা আমরা মানস ওয়াধওয়াকে নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক লেখায় উল্লেখ করেছি) মতো একজন দক্ষ বিশেষ শিক্ষাবিদকে নিয়োগ করল, তখন স্বভাবতই সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। তিনি স্কুলের একেবারে ছোটদের বিভাগ, স্প্রিং ব্লসমস-এ পড়াতেন। নিয়তি তাঁর তত্ত্বাবধানে এতটাই উন্নতি করেছিল যে সে অনায়াসে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল।
নিয়তির বয়স এখন ২৫ বছর। তার মায়ের এখনও তার জন্মের সেই দিনের কথাটা মনে পড়ে। কী প্রবল জ্বরটাই না তার হয়েছিল! তারপর তাকে চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হল, ফলে ১৫দিন ধরে তাকে হাসপাতালে রাখতে হয়েছিল। ছোট্ট নবজাতিকার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপত, আরতি তখন শক্তিশালী ওষুধের প্রভাবে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করতেন। তারপর, তাঁরা লক্ষ করলেন যে নিয়তির সার্বিক বিকাশের ধাপগুলো পেরতে বড্ড দেরি হচ্ছে। তার বাবা-মা তখন তাকে চণ্ডীগড়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে নিয়ে গেলেন। সেখানে পরীক্ষায় দেখা গেল যে সে অটিজমের আওতাভুক্ত। যখন সে কথা বলতে শুরু করল তখন এর লক্ষণগুলি আরও স্পষ্ট হল। সে কথা বলার সময় চোখের দিকে সরাসরি তাকাত না। এক কথা বারবার বলত। কারও সঙ্গে একটা কোনও নির্দিষ্ট কথোপকথন একটানা চালিয়ে যেতেও অক্ষম ছিল। নয় বছর বয়সে, তার সামান্য মানসিক প্রতিবন্ধকতাও ধরা পড়ল।
নিয়তির জীবনের মোড় দারুণভাবে ঘুরে যায় যখন সে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এনজিও সক্ষম ট্রাস্টের পাঞ্জাব কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত একটি বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেন্দ্রে যোগ দিল। সে স্কুল ভ্যানে করেই যাতায়াত করে এবং সে তার আশেপাশের বন্ধুদের নিয়ে যথেষ্ট খুশি। কারণ তারা তাকে কীভাবে সুন্দর করে সাজতে হয় বা কীভাবে স্মার্টফোনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যবহার করতে হয় এরকম ছোট ছোট কৌশল শিখিয়ে দেয়। ‘সক্ষম’-এ, সে জীবন ধারণের প্রাথমিক দক্ষতাগুলো যেমন রান্না করা বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি পালন ও নিজের যত্ন নেওয়ার মতো বিষয়গুলো রপ্ত করেছে।
আরতি জানালেন প্রথমে তিনি এবং ঋষি নিজেদের আর অন্য সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে তারা নিয়তির লালন-পালনে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন। কিন্তু তারপরে বেশ কয়েক বছর পর তিনি আবার গর্ভবতী হন, এখন অবশ্য ধীবিত (১৩) আর নিয়তি দুই ভাইবোনের পারস্পরিক বন্ধন জবরদস্ত। তাদের ঠাকুমা উমা মেহরা আলঝাইমারে আক্রান্ত হওয়ার আগে অবধি নিয়তির যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছেন। আজও, নিয়তি এবং তার ঠাকুমা একসঙ্গে গান শুনে দীর্ঘ সময় কাটায়, নিয়তি আবার সেটা শুনতে শুনতে নাচতে ভালবাসে। তার বারবার একই কাজ করে যাওয়ার প্রবণতাটা রান্নাঘরের কাজে বেশ সুপ্রযুক্ত হয়েছে। সে একটানা বসে ছয় থেকে সাত কিলো মটরশুঁটির খোসা একবারে ছাড়িয়ে ফেলতে পারে!
আরতির ভাই সম্প্রতি দিদিকে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রথমে তিনি একা এই সফরে যাওয়া নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। তিনি ওখানে গেলে নিয়তির দেখাশোনা কে করবে? কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যরা যখন তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে তাঁরা মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তখন তিনি নিশ্চিন্তে ভ্রমণের এই জরুরি অবসরটুকু পেয়ে গেলেন।
নিয়তি নানারকম সাজপোশাক পরতে, পরিবারের সঙ্গে বাইরে গিয়ে খেতে, তার বাবার সঙ্গে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বেড়াতে যেতে এবং টিভি দেখতে ভালবাসে। নিজের সমস্ত অক্ষমতা সত্ত্বেও সে তার জীবনের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে।