সাধারণ মানুষ হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না যে একজন সম্পূর্ণ অন্ধ মানুষেরও প্রিয় রঙ থাকতে পারে। কিন্তু ভোপালের ১৮ বছর বয়সী নিকিতার প্রিয় রঙ হলো সাদা। রঙ অন্ধ ব্যক্তিদের জন্য একধরনের বিমূর্ত ধারণা, কিন্তু তারা রঙ উপলব্ধি করে—শুধু দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের মতো নয়, ভিন্নভাবে।
নিকিতা, দেবশিলা ও রতন লোখান্ডের তিন মেয়ের মধ্যে ছোটো মেয়ে। জন্মের ছয় দিনের মাথায় তার অন্ধত্ব ধরা পড়ে। তার বাবা-মা চিকিৎসার আশায় বিভিন্ন জায়গায় ছুটেছিলেন—প্রথমে ভোপালের শংকর নেত্রালয়ে, তারপর পাঁচ বছর বয়সে দিল্লির এমস-এ। ২০১৬ সালে তার চোখের অপারেশন হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে আরও চিকিৎসা চললেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। অবশেষে পরিবার মেনে নেয় যে নিকিতা শুধুমাত্র আলো অনুভব করতে পারে এবং দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারে।
সৌভাগ্যবশত, নিকিতা তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সঠিক জায়গা থেকে সাহায্য পেয়েছে। যখন তার সাত বছর বয়স তখন দৃৃষ্টিহীন কল্যাণ সংঘ থেকে ‘সুধীর কালে স্যার’ নামের একজন শিক্ষক সপ্তাহে তিনদিন করে তাকে কয়েক বছর ধরে তার বাড়িতে এসে ব্রেইল শেখাতেন। নিকিতা গভর্নমেন্ট দীপশিখা স্কুলে পড়াশোনা করেছে। যদিও সেখানে কোনো ব্রেইল শিক্ষক ছিল না, তবে শিক্ষকরা অত্যন্ত সহায়ক ছিলেন। সে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেই স্কুলে পড়াশোনা করেছিল।
রতন সরকারি চাকরি করতেন, আর নিকিতার দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব ছিল মা এর কাঁধে। ২০২২ সালে ৫৫ বছর বয়সে তার মা এর মৃত্যু হলে, ১৫ বছরের নিকিতার যত্ন নেওয়ার নতুন দায়িত্ব পড়ে তার বাবার ওপরে এবং তার ফলে রতন দিশেহারা হয়ে যায়। তিনি এমনকি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবেন, কিন্তু সহকর্মীরা তাঁকে করতে বাধা দেয় এবং তাঁর কাজ ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় l যদিও তাঁর অবসর নেওয়ার আর মাত্র কয়েক বছর বাকি ছিল—২০২৫ সালের ৩১ মার্চ, ৬২ বছর বয়সে।
উমঙ্গ গৌরব দীপ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি থেকে দীপ্তি ম্যাডাম যিনি বধির-মূক শিশুদের জন্য কাজ করে, তিনি নিকিতাকে ওপেন স্কুল ব্যবস্থার মাধ্যমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে সাহায্য করেন। তার বাবা বলেন, তিনি সকালে নিকিতাকে উমঙ্গে পৌঁছে দিতেন। এক সহৃদয় প্রতিবেশী দুপুরে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন এবং বাড়িতে এনে রতনের বানানো টিফিন খাওয়াতেন। তারপর দুপুর ২টার মধ্যে তিনি নিকিতাকে দীপশিখা স্কুলে নিয়ে যেতেন, আর রতন বিকেল ৫টায় গিয়ে তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন।
দেবশিলার অনুপস্থিতিতে, রতনকে নিকিতার শারীরিক দিকগুলোও সামলাতে হতে হয়েছিল। সাধারণত ভারতে—এবং হয়তো পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও—মায়েরাই কন্যাসন্তানের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার যত্ন নিয়ে থাকে। অনেক বাবার মতোই রতনও ঋতুচক্র সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। শুরুর দিকে এমন ঘটনাও ঘটেছিল যখন তার মাসিক চলছিল তবুও তিনি বুঝতে না পেরে নিকিতাকে স্কুলে পাঠাতেন l “আমি ইন্টারনেটে খুঁজে দেখেছিলাম,” তিনি বলেন। “আমার একজন বন্ধু, যে তাঁর প্রতিবন্ধী মেয়ের যত্ন নেন, সে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল।” রতন নিজেই নিকিতার অন্তর্বাসে স্যানিটারি প্যাড লাগিয়ে দিতেন, যা পরে নিকিতা পরে নিত।
একাদশ শ্রেণির জন্য নিকিতাকে সরকারি নবীন কন্যা বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ব্লাইন্ড (এনএবি)-এর একটি চুক্তি রয়েছে, যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে। বর্তমানে নিকিতা দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে এবং গত এক বছর ধরে সে এনএবি-র হোস্টেলে থাকে, শুধু সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসে। সেখানে তাকে জীবনদক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে সে নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাধীনভাবে সামলাতে পারে, এবং সে এখন সাদা লাঠি (এটি এমন একটি যন্ত্র যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দ্বারা ব্যবহার হয়) ব্যবহার শুরু করেছে।
বাড়িতে থাকলে নিকিতা সকাল ৮টায় ঘুম থেকে ওঠে, সকাল ৯টার দিকে চা খেয়ে স্নান করে, তারপর পূজা করে—সে বুদ্ধের ভক্ত। এরপর সে স্কুলের পড়াশোনা করে। নিকিতা রতনকে ঘরের কাজেও সাহায্য করে—যেমন ঝাড়ু দেওয়া, ময়দা মাখানো, বাসন ধোয়া ইত্যাদি। তার দুই বড় বোন জ্যোতি ও নেহা, দু’জনেই বিবাহিত এবং তাদের সন্তান আছে তাই তারা অন্য জায়গায় থাকে। আগে নিকিতা তাদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে ভালোবাসত, এখন তার খেলার প্রতিদ্বন্দ্বী হলো কাজিন রানি। নিকিতা চাউমিন খেতেও খুব ভালোবাসে!
তার গান গাওয়ার আগ্রহ ও সংগীতপ্রেম লক্ষ্য করে রতন তার জন্য একটি হারমোনিয়াম কিনে দেন, যা নিকিতা নিজে নিজেই বাজানো শিখছে। রতন বলেন, “আমার আত্মীয়রা বলত, ওর পড়াশোনার পেছনে সময় আর টাকা নষ্ট করছ কেন? আমরা তো ওকে দেখাশোনা করবই। কিন্তু আজ, যখন ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে, সেই একই লোকেরা বলে ওকে পড়াশোনা করিয়ে আমি ভালো কাজ করেছিl আমি চাই ও স্বনির্ভর হোক।”
নিকিতার স্বপ্নও ঠিক সেটাই—নিজে উপার্জন করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। আর যদি সে এভাবেই সহযোগিতা পেতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে সে নিশ্চয়ই তা অর্জন করবে—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।