Icon to view photos in full screen

"আমি আট মাস বয়স থেকে ফিজিওথেরাপি নিচ্ছি। আমি ‘সক্ষমে’ কাটানো সময়টা বেশ উপভোগ করি"

শৈশবেই কঠিন রোগ ধরা পড়া, স্কুলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ এবং একটি বৃত্তিমূলক কেন্দ্রে নিয়মিত প্রশিক্ষণ অমৃতসরের মানস ওয়াধওয়ার (২১) জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সহায়তা পেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও কীভাবে জীবনে সাফল্য পেতে পারে সেদিক থেকে মানস একজন আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
যদিও শৈশবে তার সবকিছুর শুরুয়াতটা বেশ নড়বড়ে ছিল। তার মা চেরি ওয়াধওয়া যখন প্রায় সাত মাসের গর্ভবতী ছিলেন তখন একদিন প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ায় তাঁকে অবিলম্বে সিজারিয়ান সেকশন অস্ত্রোপচারের সুপারিশ করা হয়েছিল। শিশুটির যখন প্রায় চার মাস বয়স, তখন চেরি এবং তাঁর স্বামী আশিসের মনে খটকা লাগে, যে সবকিছু মনে হয় ঠিক নেই। ইতিমধ্যেই চার বছরের মেয়ে সাধিকার দৌলতে তাঁদের পিতৃত্ব-মাতৃত্বের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলই, তাই তাঁরা নবজাতক শিশুটির বিসদৃশ গতিবিধি লক্ষ্য করলেন। তাঁদের সন্দেহ হল যে ছেলেটির বৃদ্ধির লেখচিত্রটা তার বয়সী গড়পড়তা বাচ্চাদের থেকে আলাদা। হাসপাতালে যাওয়া-আসা শুরু হল তাঁদের। প্রাথমিকভাবে এর সম্ভাব্য কারণ অনুমান করে একটি থাইরয়েড পরীক্ষার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এমআরআই এবং ইইজির পর চিকিৎসকরা নিশ্চিত হলেন যে মানসের সেরিব্রাল পলসি (সিপি) হয়েছে। মানসের যখন মাত্র আট মাস বয়স, তখন থেকেই তার ফিজিওথেরাপি শুরু হয়, যা এখনও চলছে।
 
মানস প্রথমে প্লে-স্কুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু অমৃতসরের স্প্রিং ডেল সিনিয়র স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়াটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেখানে তার পরিচয় ঘটে প্রেরণা খান্না নামে একজন মমতাময়ী বিশেষ শিক্ষাবিদের সঙ্গে। তিনি অন্তর্ভূক্তিমূলক শিক্ষাকে মূলধারার স্কুল ব্যবস্থার অংশ করার প্রক্রিয়ায় ছিলেন নেত্রীস্থানীয়। আসলে তাঁর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পথচলাই তাঁকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আজ অন্যান্য অভিভাবকরাও তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এবং সিপি বিষয়ে সমাজের সর্বস্তরে সংবেদনশীলতা, এর সম্পর্কে অবহিত করা এবং আরও সচেতনতা তৈরি করতে সহায়তা করছেন। চেরি সক্রিয়ভাবে এর সঙ্গে জড়িত।
মানসের নিজের স্কুলে মানিয়ে নিতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। চেরি কথাপ্রসঙ্গে বললেন, “শিশুরা হচ্ছে 'ভেজা নরম মাটি'র মতো (ভেজা কাদামাটির তালের মতো, যাদের ইচ্ছেমত গড়ে নেওয়া যায়)।” স্কুলের অন্যান্য বাচ্চারা মানসকে উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করেছিল। সর্বোপরি তাদের এই 'প্রেরণা-ম্যাম' বাচ্চাদের খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া, বাচন দক্ষতা তৈরি করা এবং সামগ্রিক বিকাশে যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে লক্ষ্যে সদা অবিচল।এই অনুকূল পরিবেশই তাকে ২০২২সালে দশম শ্রেণি র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
মানস এখন তার জীবনের পরবর্তী পর্ব উপভোগ করছে, সে বর্তমানে ভারতীয় বিদ্যাভবন অমৃতসর কেন্দ্রের একটি সেবা প্রকল্প ‘সক্ষম ভবন আশ্রয়ের’ সঙ্গে যুক্ত। এটি বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য একটি বৃত্তিমূলক তথা পুনর্বাসন কেন্দ্র। সকাল ৯:৩০টা থেকে দুপুর ২:৩০টা পর্যন্ত মানস এই কেন্দ্রে সময় কাটায়। যেখানে সে শুধুমাত্র ফিজিওথেরাপি এবং পেশাগত পরিচর্যা নেয় তাই নয়, বরং তাকে জীবনের বিবিধ প্রয়োজনীয় দক্ষতা, দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম, রান্না-বান্না, শিল্পকলা ও কারুশিল্পের পাঠও দেওয়া হয়। তার একদল ভালো বন্ধু আছে যারা একসঙ্গে গান গায়, নাচে বা টেবিল ক্রিকেট খেলে। এই কেন্দ্রের বাচ্চারা নিজে হাতে বেশ কিছু পণ্যসামগ্রী বানায়। যেমন, রাখি, খাম, কাগজের থলে, ওয়াইন ব্যাগ, প্রদীপ এবং মশলাপাতি। বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের এইসব সামগ্রী প্রদর্শন করার মাধ্যমে তাদের অর্থ উপার্জন করার সুযোগ খুঁজে দেন। চেরি এবং আর পাঁচজন মা ও স্বেচ্ছাসেবকেরা এই ধরণের প্রদর্শনীর পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকেন।
মানস বাড়ির ভিতরে চলাফেরা করার জন্য একটি ওয়াকার যন্ত্র এবং বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় একটি হুইলচেয়ার ব্যবহার করে। ফিজিওথেরাপি তাকে নিজে নিজে টয়লেট যেতে, খাবার খেতে এবং নিজের জামাকাপড় বদলাতে অনেক সাহায্য করেছে (সেগুলি পরতে অবশ্য তার সাহায্যের প্রয়োজন)।এই ফিজিওথেরাপির সেশনগুলি এখনও তার কাছে খুব যন্ত্রণাদায়ক। মাঝে মাঝে সে মেজাজও হারিয়ে ফেলে, কিন্তু আবার দাঁতে দাঁত চিপে সবটা সহ্য করে নেয়।
মানস আর তার দিদি সাধিকার সম্পর্ক যথেষ্ট নিবিড়। একবার যখন মানস কানাডায় গিয়ে সেখানে ১৮মাস ছিল, তখন দিদির জন্য সে এতটাই আকুল হয়ে পড়েছিল যে তারা বিভিন্ন সময় অঞ্চলে অবস্থান করা সত্ত্বেও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদিন ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখত। সকলের প্রতি চেরির বার্তা হল: “প্রতিবন্ধীদের প্রতি করুণা না করে বরং তাদের প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে তাদের জন্য আপনার উদ্বেগ প্রকাশ করুন। নিজেদেরকে যথাযথভাবে শিক্ষিত করুন এবং এই সমাজে তাদের বসবাসের জায়গা তৈরি করে দিতে আরও সচেতন হয়ে উঠুন।”

ছবি:

ভিকি রয়