পোর্ট ব্লেয়ারের গভর্নমেন্ট মডেল সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষকরা যখন ক্লাসে প্রশ্ন করেন, তখন সচরাচর নয় বছর বয়সের জি. গৌতমের হাতই সবার আগে ওঠে। চট করে বিষয়গুলিকে তার আয়ত্ত করার ক্ষমতা এবং তার প্রখর স্মৃতিশক্তি দেখে তাঁরা প্রায়শই তাকে অন্যান্য সহপাঠীদের কাছে এক আদর্শ ছাত্র হিসাবে তুলে ধরেন। গৌতম ১০০ শতাংশ অন্ধত্বের শিকার।
“ওর যখন প্রায় চার বছর বয়স, তখনও পর্যন্ত গৌতম কোনোকিছুর দিকে তাকালে অন্ততপক্ষে কিছু ধোঁয়াটে আকৃতি দেখতে পারত। কোনও জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়াও এড়াতে পারত,” তার মা জি. জয়ার বক্তব্য। তিনি সারাজীবন ধরে আন্দামানে বসবাস করেছেন। “এখন ও কেবল অন্ধকার আর আলোকে আলাদা করে বুঝতে পারে। যদি কোনো বস্তু উজ্জ্বলভাবে আলোকিত হয় এবং সে সেটিকে তার চোখের খুব কাছে ধরে রাখে তাহলে সে বস্তুটির রঙ চিনতে পারে।” জয়া একটি পান্থশালায় রান্না ও সাফাইয়ের কাজ করেন। আর তাঁর স্বামী গণেশ মূর্তি সৌদি আরবে চাকরি করেন। এখন তিনি দু’মাসের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন, চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ে গৌতমের চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য। জয়া আমাদের বললেন, “ওর হয়তো একটা চক্ষু প্রতিস্থাপনের দরকার, কিন্তু ডাক্তাররা বলেছেন যে ওর চোখের পেশিগুলো এখনও ইমপ্লান্টটাকে ধরে রাখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। ওর চোখের চাপ সংক্রান্ত কিছু সমস্যাও রয়েছে। ওঁরা এই মাসেই ওর অস্ত্রোপচার করবেন বলেছেন।” গৌতম পাশ থেকে জুড়ল, “আমি একটা প্লেনে চেপে গিয়েছিলাম।”
গণিত তার প্রিয় বিষয়। এখন সে একজন ব্রেইল পদ্ধতির শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাই শীঘ্রই ব্রেইল পদ্ধতির বইগুলো সে পড়তে পারবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানে সে অডিও বই শোনে। হেলেন কেলারের জীবনের গল্প শুনেছে ইতিমধ্যেই। গান তার কাছে স্রেফ শখ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। জয়া বলেন, “মিউজিক উসকি জান হ্যায় (সঙ্গীতই ওর জীবন)।” “ছোটবেলা থেকেই ও রান্নাঘরের বাসনকোসন ঠুকে বিভিন্ন রকম আওয়াজ করত।” একটু বয়স বাড়তেই তাঁরা তাকে গান শেখাতে ভর্তি করে দেন। এখন সে কীবোর্ড আর তবলা বাজানো শিখছে, এমনকি দূরদর্শনে তিনবার অনুষ্ঠানও করা হয়ে গেছে তার!
স্কুলে যদিও গৌতম তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পায়, কিন্তু বাড়িতে তাকে একা একাই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। কারণ এলাকায় তার বয়সি কোনো শিশু নেই। সে তাই ‘ভবানী-ম্যাম’-এর সঙ্গে তার সাপ্তাহিক ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ভবানী একজন বিশেষ শিক্ষাবিদ যাঁর কথা আমরা সম্প্রতি আরিয়ান বিশ্বাসের গল্পে উল্লেখ করেছি। আগামী সপ্তাহেও EGS-এ আমরা আবার তাঁর দেখা পাব। প্যারালিম্পিক বিজয়ী মহিলা দৌড়বীর এম. ভবানী, প্রতিবন্ধী শিশুদের একটি দলকে সপ্তাহে একবার খেলতে নিয়ে যান৷ “আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়াতে আর ক্যাচ-ক্যাচ খেলতে ভালবাসি,” গৌতম আমাদের জানাল।
তার আর একটি পছন্দের অবসরযাপন হল যত প্রিয়জনদের ডেকে ডেকে গল্প করা - পিসি, তুতো ভাই-বোন, ঠাকুমা-ঠাকুরদা, বড়দাদা সঞ্জয় - তাঁদের সবার সঙ্গে প্রতিদিন সে আড্ডা দেয়। তার প্রায় ৩০টি ফোন নম্বর মুখস্থ। যেহেতু তার ফোনে একটি বিশেষ ‘টকব্যাক’ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাই তাকে প্রথমে শুধু যে কোনও একটা নম্বর বলতে হয় স্পিকারে। মজার কথা তার তিন-তিনখানা বোতামওয়ালা ফোন আছে! প্রতিবার জয়া তাকে একটি করে ফোন কিনে দিলেই সে অভিযোগ করত যে ফোনটায় এই ফিচার নেই, সেই ফিচার নেই। অবশেষে তিনটি কেনার পর সেই সবগুলো মিলে তার এইসব প্রযুক্তিগত চাহিদা পূরণ করেছে বলে মনে হয়।
গৌতম তার ১২ বছরের বড় দাদা সঞ্জয়কে খুব মিস করে, যে এখন বেঙ্গালুরুর ইস্ট ওয়েস্ট কলেজে এভিয়েশন ম্যানেজমেন্টের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সঞ্জয় আমাদের জানায় যে তারও দৃষ্টিজনিত কিছু সমস্যা ছিল, তবে সেটা তার ছোট ভাইয়ের মতো এত গুরুতর না। গর্বিত সঞ্জয়ের কথায়, “ও আমার চেয়েও বুদ্ধিমান। নিজের বয়সের তুলনায় ও অনেকটাই পরিণত। ওর কথাবার্তা একদম বড়দের মতো।” গৌতমের একটি দুষ্টুমির কান্ড এই প্রসঙ্গে বলল সে: তার মা জয়ার সম্পর্কে লোকজন কে কী কথা বলে, গৌতম চুপিচুপি সেসব শুনতে থাকে, গোপনে সেগুলি তার ফোনে রেকর্ড করে, তারপর বাড়িতে ফিরে মা-কে সেগুলো চালিয়ে শোনায়! সঞ্জয় যখন বাড়িতে ফেরে তখন সে গৌতমকে না জানিয়ে পা টিপে টিপে তার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে কিন্তু প্রতিবারই তার কাছে ধরা পড়ে যায়। (যারা দেখতে পায় না, তাদের শ্রবণশক্তি প্রখর হয়।) “আমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা ও নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে, তারপর ছুট্টে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমার দু’হাতের মধ্যে ঢুকে যায়” সঞ্জয় বলল।
একটা কাপ হাতে গৌতমের সাম্প্রতিক একটি ছবি দেখালেন জয়া– “একটা দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার জন্য ওর পুরস্কার এটা।” হিন্দি চলচ্চিত্র ‘লাডলা’-র “তেরি উংলি পাকড় কে চালা” (আমি তোমার আঙুল ধরে হেঁটেছি) তার প্রিয় গান। তবে সারা দুনিয়া ঘোরার জন্যেও তার নিজের কারও হাত ধরার প্রয়োজন হয় না। তার এই গন্ডির বাইরে যেতে চাওয়ার প্রবণতা এবং তার আলোকিত মানসিকতার জন্যই, কে জানে, একদিন হয়তো সে নিজেই অন্যান্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দিকে তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।