Icon to view photos in full screen

“আমি অলিম্পিকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই”

“কখনও ভাবিনি যে আমি এতটা স্বনির্ভর হব!” কিশোরী বয়সে যখন একটা অর্থোপেডিক জুতো তার পা-কে তুলে ধরতে সাহায্য করল, তখন এটাই ছিল ভবানীর প্রতিক্রিয়া। এখন, অন্যান্য প্রতিবন্ধী মানুষদেরও স্বাধীন করে তোলাটাই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি অপেক্ষাকৃত ছোট ডান পা নিয়ে জন্মানো, এম. ভবানী (৩১) রাঙ্গাচং-এর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ছিলেন। যখন তিনি একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন, তখন একটি চিকিৎসা শিবিরে যোগদান করেছিলেন। সেখানে তাঁর দু'পায়ের উচ্চতার ৫-ইঞ্চি ব্যবধান মেটানোর জন্য তাঁকে একটা বিশেষ জুতো পরানো হয়েছিল। ১৬ বছর বয়সী ভবানী ঘুণাক্ষরেও জানত না যে এই ঘটনাটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
স্কুলের পাট চোকানোর পর, ভবানী ডিএড (সামাজিক শিক্ষা) বিভাগ নিয়ে পড়েন। তিনি এখন 'সর্ব শিক্ষা অভিযান'-এর একটি অংশ হিসাবে শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে একটি চুক্তিভিত্তিক কাজে নিযুক্ত। সেখানে তিনি প্রতিবন্ধীদের অধিকার আইনে উল্লিখিত ২১টি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা বিভাগের তালিকাভুক্ত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদান করেন।
২০২১ সালে, নৌবাহিনীর হাসপাতালে একটি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কাউন্সেলিং অধিবেশন চলাকালীন, ভবানীকে খেলাধুলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তিনিও অবিলম্বেই ১০০ মিটার দৌড়ের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করে দেন। ১৯তম জাতীয় প্যারা অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার দৌড়ে তাঁর সর্বপ্রথম জয়ের পরে তিনি আনন্দে উদ্বেল হয়ে গেছিলেন। "আমি কখনও ভাবতেই পারিনি যে আমি এই ইভেন্টে জিততে পারব," তিনি বলেন।
ভবানী তাঁর এই সাফল্যের কৃতিত্ব দিতে চান খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ কে.পি. মাম্মুকে। আন্দামান নিকোবর পুলিশ ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মী 'আন্দামান এক্সপ্রেস' নামে পরিচিত। ভবানীকে তিনিই দৌড়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ভবানীর জঠরের আগুন আর পায়ের ক্ষিপ্র নড়াচড়া দেখে সহজেই তাঁকে চিনে নিতে পেরেছিলেন মাম্মু।
২০২১ সালে ভবানী তাঁর প্রথম রৌপ্য পদকটি জেতার অল্প সময়ের মধ্যেই একটি বাধার সম্মুখীন হলেন। পোর্ট ব্লেয়ারে তাঁর দৌড়ের প্রশিক্ষণের জন্য কোনও উপযুক্ত ট্র্যাকই নেই! কিন্তু একজন সত্যিকারের অ্যাথলিটের মতো, তিনি লাফ দিয়ে সেই বাধা টপকে পার হতে পেরেছিলেন, তারপর লং জাম্পেও প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
এরপর থেকে আর কোনো বাধাই ভবানীকে দমাতে পারেনি। এখন পর্যন্ত, তিনি ১০০ মিটার দৌড় এবং লং জাম্প উভয় ক্ষেত্রেই ভারত জুড়ে হওয়া বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চারটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য এবং দুটি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন। “আমার নিজস্ব জায়গা, আমার দেশের জন্য কিছু করা আমার স্বপ্ন ছিল। অ্যাথলেটিক্স আমাকে সেই অবদান রাখার সুযোগ দিচ্ছে,” তাঁর কথা।
ভবানী শিক্ষা বিভাগের সদস্যদের সদিচ্ছার জন্য তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁদের মধ্যেই কয়েকজন গোয়ায় ২২তম জাতীয় প্যারা অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০২৪-এ অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। সেখানে তিনি লংজাম্পে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। ভবানী জেলার শিক্ষা আধিকারিক সঙ্গীতা চন্দ এবং জ্ঞান শীল দুবের আন্তরিক সহযোগিতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যাঁরা তাঁর এগিয়ে চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রভূত সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। “স্কুলে আমার সহ-শিক্ষকরাও খুব সাহায্য করেন; তাঁরা আমার খরচের জন্য চাঁদা তুলে টাকার জোগাড় করে দেন,” ভবানী বললেন।
ভবানীর জীবনের একটি সাধারণ দিনের সূচিও থাকে একেবারে ঠাসা। নিজের জন্য বা শখ পূরণের জন্য কোনও সময় পান না তিনি। একজন বিশেষ শিক্ষাবিদ এবং ছয় বছর বয়সী সন্তান অর্ণবের মা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি, ভবানী জুনিয়র গেমসের অন্যান্য ক্রীড়াবিদদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। অন্যান্য শিক্ষকরাও তাঁর কাছে বিভিন্ন সামাজিক কাজের প্রশিক্ষণ নিতে আসেন।
ভবানীর লক্ষ্য: “আমি আন্দামানকে অলিম্পিকের মঞ্চে নিয়ে যেতে চাই। আমি এই দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের সবাইকে গর্বিত করতে চাই।” পুরস্কার এবং খ্যাতির বাইরেও, তিনি এই ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে প্যারালিম্পিক গেমস এবং খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধার দিকেও বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন, যা ছিল বহু প্রতীক্ষিত। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ক্রীড়া সচিব প্যারালিম্পিক ক্রীড়াবিদদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো তৈরির বিষয়ে ভবানীর কাছে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এখন তা নিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছেন ভবানী। এমতাবস্থায় ভবানী এই দ্বীপপুঞ্জে প্যারালিম্পিক ক্রীড়াজগতে এক আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন, যার শুরুটা করতে হবে মাঠ থেকেই।
ভবানী তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় অবিচল। তিনি এখন যোগিতা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, যেখানে তিনি প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্রীড়া প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন। “এই দ্বীপপুঞ্জের বাবা-মায়েরা আমাকে বলেছেন যে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এখানে খেলাধুলার কোনও সুযোগ সুবিধাই নেই। এমনকি বড় হলে চাকরির সম্ভাবনাও তেমন থাকে না। আমি চাই প্রতিবন্ধী শিশুরা স্বাধীন ও স্বনির্ভর হোক। খেলাধুলো তাদের এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। আন্দামানে খেলাধুলার সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকা উচিত। আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অন্তত একজনও যদি প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারে, তাহলে সেটাই একটা দারুণ ব্যাপার হবে।”

ছবি:

ভিকি রয়