Icon to view photos in full screen

“আমি ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি, কারণ সেটা আমাকে শক্তি জোগায় এবং আমার অবস্থা সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করা থেকে দূরে রাখে…”

হিমাচলের দাদ গ্রামের উচ্চতর অংশের বাসিন্দা ভগবতী দেবীর (৩৪) যখন পাঁচ বছর বয়স, তখনই প্রতিবেশিরা সবাই লক্ষ করেছিল যে মেয়েটি শুধু নিজের পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাঁটছে। যদিও তার বাবা-মা এটা নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন না, মেয়ে স্রেফ মজা করছে বলে একপ্রকার উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন রজনী (ভগবতী নিজেকে এই নামেই পরিচয় দিতে পছন্দ করে) চতুর্থ শ্রেণিতে উঠল, তখন তার মা কুশলা দেবী এবং কৃষিজীবী বাবা, অধুনা পরলোকগত অমিচাঁদ বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁদের মেয়ে উঠে দাঁড়াতে বা হাঁটার চেষ্টা করতে গেলে মুশকিলে পড়ছে। তো, সচরাচর হিমাচল প্রদেশের গ্রামীণ লোকেরা যেমনটা করতে অভ্যস্ত, তাঁরাও সে পথেই হেঁটে সনাতনপন্থী চিকিৎসার দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু যখন বৈদ্য বা হাকিম কেউই কোনও প্রতিকার করতে পারলেন না, তখন তাঁরা বাধ্য হয়ে হাতুড়ে আর ঝাড়ফুঁক করা গুণিনদের দ্বারস্থ হলেন। কিছুতেই কিছু হল না।
২০০১ সালে যখন রজনী অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, তখন অবশেষে তার অভিভাবকরা তাকে লুধিয়ানার দয়ানন্দ হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানে ধরা পড়ে সে লিম্ব গার্ডল মাস্কুলার ডিস্ট্রোফি (এলজিএমডি)-তে আক্রান্ত। মাসকুলার ডিস্ট্রোফি বা পেশিগত অপুষ্টি এমন একটি রোগ যা হাঁটাচলার ক্ষেত্রে দুর্বলতা সৃষ্টি করে এবং পেশিকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু করে দেয়। ওখানকার চিকিত্সকরা অবশ্য এসবের বিশদ বিবরণ দেননি, শুধু বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে তার এই সমস্যা আরও বাড়বে। কিন্তু ইতিবাচক মানসিকতাসম্পন্ন রজনী এতে ভেঙে পড়েনি। “সবচেয়ে খারাপ কীই বা ঘটতে পারে, দেখাই যাক” এই ছিল তার মনোভাব।
সে পাক্কা দু'কিলোমিটার হেঁটে দাদের সরকারি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে পড়তে যেত। সে যখন নবম শ্রেণির ছাত্রী,  তখন তার চার বছরের ছোট ভাই সঞ্জয় কুমার, ওই স্কুলেই ভর্তি হয়। সেই থেকে তারা একসঙ্গে স্কুল যাওয়া শুরু করল। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় তারা অনেকটা আগে বাড়ি থেকে স্কুলে রওনা হত। কারণ রজনীর ওই দূরত্বটুকু পেরতেই অনেক সময় লাগত। তার কথায় স্কুলে তাকে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি, কিন্তু বাস্তবে তার শিক্ষকরা তার এই অবস্থা সত্ত্বেও তার প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল ছিলেন না। যেমন প্রবল ঠাণ্ডার সময়, শীতের মরসুমে তাঁরা সূর্যের তাপ পাওয়ার জন্য বাইরে মাটিতে বসে ক্লাস করাতেন, কিন্তু তার অক্ষমতার দরুন রজনীর পক্ষে এটা করা বেশ কঠিন ছিল। ফলে তাকে বাধ্য হয়ে ক্লাস না করে ভিতরে, শ্রেণিকক্ষেই একা বসে থাকতে হত। এভাবে সে ক্লাসের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার তেমন কোনও বন্ধুও ছিল না স্কুলে।
রজনী ক্লাস টেনের পর পড়াশোনায় ইতি টানে। কারণ সেই সময় তার বাবা থেকে থেকেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। মা’কে তাঁর দেখাশোনা করতে হচ্ছিল। যদিও ভাই সঞ্জয়ের উৎসাহ আর পীড়াপীড়িতে, রজনী দূরশিক্ষার মাধ্যমে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় পাশ করে এবং মাত্র দু’বছর আগেই সে করেস্পন্ডেন্স কোর্সে বিএ সম্পন্ন করেছে।
২০০৩ সালে চিন্ময় অর্গানাইজেশন ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (সিওআরডি) এর সঙ্গে যোগ দেওয়ার বিষয়টা রজনীর ভাগ্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর মা স্থানীয় মহিলা মন্ডলের একজন সদস্যা ছিলেন। রজনী প্রায়শই তাঁর সঙ্গে সেই সভায় যোগদান করতেন। এই সভায় আসা সিওআরডি-এর একজন ক্ষেত্রস্তরের কর্মী তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেখানেই তাঁর রোগটা সম্বন্ধে তাঁকে সবিস্তারে জানানো হয়। এবং তাঁকে একটি কঠোর ব্যায়াম পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সিওআরডি তাঁকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি রাখি বানানোর মতো কিছু কাজে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। এমনকি ধীরে ধীরে তিনি গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজ করতেও লেগে পড়েন।
সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি সিওআরডি-এর কাছে কৃতজ্ঞ। শৈশব থেকেই তিনি বাইরে যেতে, লোকের সঙ্গে মিশতে অপছন্দ করতেন। তাঁর মা আমাদের এর পিছনের কারণটা জানালেন। “যখনই আমরা কোনও অনুষ্ঠানে যেতাম লোকেরা রজনীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। কারণ ওর ওঠা-বসা, হাঁটা-চলা সবেতেই কারও সাহায্য লাগত।” রজনীও আরেকটু যোগ করলেন, “আমরা কখনও বাইরে কোথাও গেলে আমার মা-কে সর্বক্ষণ আমার দিকেই মনোযোগ রাখতে হয়, আমার আশেপাশে থাকতে হয়। ফলে মা কখনওই কারও সঙ্গে নিজের মত করে দুটো কথা বলতে বা একটু অবসর নিতে পারেন না।” তাঁর দিদি চন্দ্রেশ কুমারী (৩৫) যথারীতি নিজের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন, অতএব ছোট মেয়ের দায়িত্ব সর্বদা ৫৭ বছর বয়সি কুশলা দেবীর উপরেই পড়ে।
আজ, সর্বদা ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন রজনী বললেন, যে জীবনকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা একটি চাকরি জোগাড় করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। লোকেরা যখন তাঁকে কোনোকিছু না বলেই সাহায্য করতে চেষ্টা করেন, তাঁর আদৌ সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা কেউ জিজ্ঞাসা করেন না, এই ব্যাপারটা রজনীর পছন্দ হয় না। তিনি বাড়িতেো কিছু না কিছু কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালবাসেন। যেমন একপাল মুরগির ছানাপোনাদের দেখাশোনা করা। এসব কাজ করলে তাঁর নিজেকে শক্তিশালী বলে মনে হয়, সমস্ত নেতিবাচকতাও দূর হয়।
তিনি বিয়েতে আগ্রহী নন। তিনি নিশ্চিত জানেন, এমন দিনও হয়তো আসবে, যখন তাঁকে একটা হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হবে, এমনকি হয়তো পুরোপুরি শয্যাশায়ীও হয়ে যেতে হবে। দিনে তিনবার কঠোরভাবে ব্যয়াম অনুশীলন করে তিনি সেই দিনটিকে যতটা সম্ভব পিছিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছেন। যেমন তার মধ্যে একটি ব্যায়াম হল এক ঘন্টা ধরে একটি স্তম্ভের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখা। আসলে এর মাধ্যমে তাঁর শরীরের ওজনটা সম্পূর্ণভাবে তাঁর গোড়ালির উপর রাখার চেষ্টা করা হয়। বিষয়টা মোটেও সহজ নয়, তবে এটিই তাঁর পায়ের পেশিকে শক্তপোক্ত রাখার একমাত্র উপায়।
তাঁর দৈনন্দিন রোজনামচা বেশ সহজসরল কিন্তু ব্যস্ততায় পূর্ণ। পাঁচটায় জেগে ওঠার পর তাঁর মা তাঁকে চা এনে এবার তাঁর প্রথম দফার ব্যায়ামের সময়। তারপর তিনি সারা বাড়ি ঝাঁট দেন। স্নান সেরে পুজো করে তিনি ভাই সঞ্জয়ের জন্য দুপুরের খাবার রান্না করেন, তারপর রান্নাঘর পরিষ্কার করেন। দিনের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সেটা হয়ে গেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে মায়ের সঙ্গে দুপুরের আহারাদি সারেন। কুশলা দেবী রোজ রজনীকে এই একইভাবে তাঁর রুটিন অনুসরণ করে চলতে দেখেন, আর ভাবেন যে তিনি পরপারে চলে যাওয়ার পরে, সঞ্জয় এবং তার ভাবী স্ত্রীও নিশ্চয়ই তাঁর এই সাহসিনী কন্যার যথাযথ দেখভাল করবে। এই তাঁর আশা।

ছবি:

ভিকি রয়