যখন ছয় বছর বয়সী নিক্কুর থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগটা ধরা পড়ে, তখন তার বাবা-মা যশপাল এবং উমা দেবীর ধারণাই ছিল না যে চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা এবং আজীবন পর্যায়ক্রমে হাসপাতালের দুয়ারে যাওয়াটা তাঁদের ভাগ্যের সঙ্গে জুড়ে গেছে।
নিক্কু হল অবিনেশ কুমারের (৩১) ডাকনাম। সে হিমাচলের কাংড়া জেলার ছোট্ট গ্রাম ফলন্দির (জনসংখ্যা প্রায় ৩৫০) বাসিন্দা। অবসরপ্রাপ্ত বাস কন্ডাক্টর যশপাল (৫৬) এবং গৃহবধূ উমা দেবী,(৫৬) তাঁদের বড় ছেলে দীনেশ (৩৬), তার স্ত্রী সবিতা কুমারী (৩২) এবং তাদের এক বছরের ছেলে যক্ষিত -- সবাই একসঙ্গেই থাকেন। কুমার দম্পতির সবচেয়ে ছোট সন্তান, অঞ্জনা দেবী (২৭), এমএ পাশ করেছেন।
থ্যালাসেমিয়া একটি জিনঘটিত রক্তের ব্যাধি যেখানে শরীর পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না, যা রক্তের লোহিতকণিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। থ্যালাসেমিয়া মেজরের লক্ষণগুলি সবচেয়ে গুরুতর, যেমন তীব্র রক্তাল্পতা, যার জন্য নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। আবার এই পরিসঞ্চালনের কারণে রক্তে যখন অত্যধিক মাত্রায় লোহা জমা হয়, তখন তা চিলেশন প্রক্রিয়ায় অপসারণ করতে হয়; সেটা ট্যাবলেট খাইয়ে এবং/অথবা ত্বকে সুচ ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ওষুধটা শরীরে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে করা যাবে। এই রোগের ফলে হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিও হতে পারে। যেমন কপাল বা গাল বেখাপ্পাভাবে বর্ধিত হতে পারে। কারণ অস্থি মজ্জাকে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। একটি অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপনের সাফল্যের হার খুবই কম, আবার এর পাশাপাশি এটি ঝুঁকিপূর্ণও বটে।
নিক্কু ছয় মাস বয়স থেকেই অসুস্থ ছিল, ঘন ঘন তার নাক দিয়ে রক্তপাত হত। তার বাবা-মা তখন জানতেন না যে গণ্ডগোলটা ঠিক কথায়। একদম ছোটবেলায় উমা দেবী তাকে স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়িতে (সরকারি পরিচালিত শিশুশিক্ষাকেন্দ্র) নিয়ে যেতেন। তারপর সে তার ভাই বোনের সঙ্গে গ্রামের সরকারি স্কুলে যেতে শুরু করে। ছয় বছর বয়সে তার রোগটা ধরা পড়ার পর, তাঁরা তাকে প্রতি সপ্তাহে বা দু’সপ্তাহ অন্তর রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তান্ডায় ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যেতেন।
তার রক্তাল্পতার কারণে, অবিনেশ চিরকালই দুর্বল এবং ক্লান্ত থাকত। সে খুব ধীরে ধীরে হাঁটত এবং অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে তাদের খেলাধুলায় যোগ দিতেও পারত না। তাকে এত ঘন ঘন স্কুল কামাই করতে দেখে শিক্ষকরা তার বাবা-মাকে ওকে আর স্কুলে পাঠাতেই মানা করে দেন। শিক্ষকরা প্রশ্ন করেছিলেন, “ওকে পড়াশোনা শিখিয়ে আপনাদের কী লাভ? ওর রোগ তো কখনওই পুরোপুরি সারবে না।” অন্যান্য লোকেরাও কানাঘুষো করে বলত “ছেলেটা বাঁচবে না”। কিন্তু কুমার দম্পতি এইসব মন্তব্যে কান দেননি। “আমরা কখনও চাইনি যে ও নিজেকে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা কিছু মনে করুক,” তাঁরা আমাদের বললেন। উমা দেবী যোগ করলেন, “ও যে হাঁটতে পারে, এটাতেই আমি খুশি ছিলাম, অন্য অনেকে তো সেটাও পারে না। ও নিজে না পারলেও অন্তত অন্য শিশুদের খেলা দেখে উপভোগ তো করতে পারত।“
অবিনেশ শুধু স্কুলের পড়াশোনাই শেষ করেনি, বি এ-ও সম্পন্ন করেছে! কিন্তু অনেক অসুবিধা ও কষ্ট সহ্য করে তবেই এসব অর্জন করতে পেরেছে সে। সবার উপরে রয়েছে রক্ত পরিসঞ্চালন এবং চিলেশনের যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া, যা তাকে সারা জীবন চালিয়ে যেতে হবে। ২০১৩ সালে কলেজে পড়ার অন্তিম বর্ষে অবিনেশের শরীর চিকিৎসাগত একটা ভুলের জন্য হঠাৎ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। তান্ডায় সেই চিকিত্সা করা যায়নি। তাকে লুধিয়ানার দয়ানন্দ মেডিকেল কলেজ তথা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল। প্রায় ছয় বছর আগে একটি “ভুল ব্লাড ট্রান্সফিউশন” এর ফলে তার সারা শরীর ফুলে গিয়েছিল, যার জের চলেছিল প্রায় এক বছর ধরে।
উমা দেবী আমাদের জানিয়েছেন যে অবিনেশ সম্প্রতি একটি স্প্লিনেক্টমি (প্লীহা অপসারণ) অপারেশন করিয়েছেন, যার ফলে এখন প্রতি ৪৫ দিন অন্তর একবার তার রক্ত পরিসঞ্চালন করালেই হবে। থ্যালাসেমিয়া মেজর আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, প্লীহাটা বড় হয়ে যায়। কারণ প্লীহা আরও বেশি করে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করার চেষ্টা করতে থাকে। ফলে সেটি রক্ত শোধন করা এবং অন্যান্য সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার নিজের নিয়মিত কাজটাই ঠিক করে করতে পারে না।
এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে কেন অবিনেশ মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ে এবং ভাবে, “কেন আমার সঙ্গেই এমনটা হতে হলো?” তবে, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বেশ কিছু উপায়ে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। একজন আশা কর্মী তাদের পরিবারকে চিন্ময় অর্গানাইজেশন ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (সিওআরডি) সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, যাঁরা প্রতিবন্ধীদের নিয়েও কাজ করে থাকেন। অবিনেশ এখন তাঁদের বিভিন্ন মিটিং এবং কাউন্সেলিং সেশনে যোগ দিচ্ছে। প্রায় দুই বছর আগে সি ও আর ডি-এর সহায়তায় সে গ্রামে নিজস্ব একটি দোকান খোলে। সেখানে ফটোকপি, ল্যামিনেশন, পাসপোর্ট ফটো, প্যান ও আধার কার্ড এবং নানা সরকারি প্রকল্পগুলির জন্য লোকেদের অনলাইন ফর্ম পূরণ করতে সহায়তা করার মতো সমস্ত পরিষেবা প্রদান করা হয়।