পাটনার আমিশা প্রকাশ (২২) যখন তার বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজের পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, তখন এলাকার লোকেরা তাকে “চ্যাম্পিয়ন” বলে ডাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের কথা সে শুনতে পায় না। কারণ সে আজন্ম বধি আমিশাদের যৌথ পরিবারে রয়েছেন তার বাবা বেদ প্রকাশ (৫২), মা সুনিতা প্রকাশ (৫০), দাদা বিবেক (২৪), ঠাকুমা বিমলা দেবী (৮০) এবং বেদের এক আইনজীবী ভাই, আমিশার কাকু। তাঁরও রয়েছে দুটি সন্তান। আমিশার যখন মাত্র দেড় বছর বয়স, তখনই প্রথম তার মা-বাবার মনে সন্দেহ জাগে, যে সে হয়তো শুনতে পাচ্ছে না, কারণ তাকে কিছু বললে বা ডাকলে সে সাড়া দিচ্ছে না! ডাক্তাররা অগত্যা তার দুটি কানের জন্যই হিয়ারিং এইড ব্যবহারের পরামর্শ দিল আমিশাকে সমর্পন স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। এই বিশেষ স্কুলটা ছিল মূলত মানসিক প্রতিবন্ধী বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুদের জন্য। এখানে সে সাঙ্কেতিক ভাষা শিখতে থাকল, সেইসঙ্গে বিশেষ ভর্তুকিসহ তাকে উন্নতমানের হিয়ারিং এইডের ব্যবস্থা করে দেওয়া হল (“মূল্য ₹১১,০০০ হলেও আমরা এটা মাত্র ₹৫,০০০-এ পেয়েছি”)। বেদ অবশ্য হিয়ারিং এইডে আমিশার খুব একটা উপকার হয়েছে বলে মনে করেন না। বরং সাঙ্কেতিক ভাষা এবং ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে কথা বোঝার ক্ষেত্রেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তার পরিবারের লোকেরা যদিও সাঙ্কেতিক ভাষা শেখেনি কিন্তু তার সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করার জন্য নিজস্ব কিছু অঙ্গভঙ্গি তৈরি করে ন স্কুলে আমিশা খেলাধুলায় বেশ ভাল ছিল। সমর্পন কর্তৃপক্ষ তাকে এই দিকে মনোযোগ দেওয়ার, অনুশীলন করার পরামর্শ দেন। তাকে সন্দীপ কুমারের তত্ত্বাবধানে রাখার ব্যবস্থা করে দেন(যাঁর জিমন্যাস্টিকসে দক্ষতার কথা আমরা ইজিএস-এ উল্লেখ করেছি), যিনি বিহারের প্যারালিম্পিক কমিটির সেক্রেটারি এবং স্পেশাল অলিম্পিক ভারত বিহারের ক্রীড়া অধিকর্তা। সন্দীপের উৎসাহে এবং তার পরিবারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, আমিশা অষ্টম শ্রেণির পরে স্কুলের পাট চুকিয়ে পুরোপুরি খেলাধুলায় নিয়োজিত হয়। সন্দীপের জিমন্যাস্টিকস একাডেমি এবং স্পেশাল অলিম্পিক ভারত একাডেমিতে যোগ দেয় সে। আর পড়াশোনার দিকটা দেখার জন্য তারই স্কুলের একজন শিক্ষক বাড়ি এসে তাকে পড়ানো শু গত এক দশক ধরে আমিশার ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য বেড়েই চলেছে। রেসিং এবং ফুটবলসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার বিভাগে সে অংশগ্রহণ করতে থাকে। রাজ্যস্তরে খেলাই শুধু নয়, বিহার সরকারের কাছ থেকে বিশেষ স্বীকৃতি অর্জন এবং নগদ পুরষ্কার জেতার পর সে জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরেও পৌঁছে গেছে। ২০২০ সালে সে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে অনুষ্ঠিত ১৫তম জাতীয় প্যারা অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক বিজয়ী হয়। ২০২৩ সালে ১৮ তম জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা জেতে আমিশা। ইউনিফাইড স্পোর্টস এমন একটি ক্রীড়াবিভাগ যেখানে সুস্থ, স্বাভাবিক এবং প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা একসঙ্গেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ২০২২ সালের অগস্ট মাসে ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত বিশেষ অলিম্পিকের ইউনিফাইড কাপে ব্রোঞ্জ জয়ী ভারতীয় ফুটবল দলের একজন অন্যতম সদস্যা ছিল আমিশা। গত মাসে গোয়ায় ছ’দিনের পার্পল ফেস্টে সে ব্রোঞ্জ পদক জিতে ন খেলাধুলার অনুশীলনই এখন আমিশার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। প্রতিদিন ভোর ৪:৩০-এ উঠে সে একাডেমিতে রওনা হয়। প্রথম প্রথম সে সাইকেল চালিয়ে যেত, সঙ্গ দিতেন তার বাবা। কিন্তু আরেকটু স্বাবলম্বী আর বড় হতেই সে একটা দু’চাকার মোটরগাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলল। বাইকের আয়না দেখেই সে রাস্তায় চলতে অভ্যস্ত, যেহেতু পেছনের ট্রাফিকের শব্দ তার পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। একাডেমিতে সে এখন অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও করছে। “ওকে একজন চূড়ান্ত অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দেখা হয় এখন,” বেদের কথায় গর্বের সুর। তার কাকুরও খুব স্নেহের পাত্রী সে, বাড়ি ফিরলেই কাকুর সঙ্গে নৈশভোজ সারার পরিকল্পনা করে বেদ আগে দুগ্ধ ও গব্যদ্রব্যের ব্যবসা চালাতেন, এখন তাঁর মেয়ের দিকে সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ দেওয়ার জন্য সেটা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর পরিবার এখন ভাড়ার থেকে আসা আয়েই চলে। আমিশা আমাদের জানাল, “যেহেতু আমার অধিকাংশ খরচ আমার পরিবারই বহন করে, তাই অন্তত কিছুটা নিজের অবদান রাখার জন্য আমি এখন একটা চাকরি চাই৷ আমি খেলাধুলাটাও সমানভাবে চালিয়ে যেতে চাই অবশ্য। আর মোটামুটি ২৮ বছর বয়স হলে তখন হয়তো আমার বিয়ের কথা ভাবব একটি বধির সন্তান জন্মানোর বিষাদ আর প্রাথমিক হতাশা কাটিয়ে পরিবারটি এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বেদের কথায়, “আমরা নিরাশার মনোভাব দূর করে এখন পরম সমাদরের চোখে দেখি ওকে। ও আমাদের পরিবারের গর্ব, আমাদের সম্মান”।