Icon to view photos in full screen

"আমি কখনও নিজের জন্মদিন পালন করিনি। প্রত্যেকের উচিত প্রতিটি নতুন দিন উদযাপন করা, কারণ কেউ জানে না জীবনে কী লেখা রয়েছে।"

কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার ওয়াঘাম গ্রামের বাসিন্দা আমির হুসেন লোন নিশ্চিত নন যে, তিনি ঠিক কবে জন্মেছিলেন; তার অনুমান ১৯৮৯-এ। কিন্তু যে বছর তিনি নিজের ভাইয়ের জন্য দুপুরের খাবার দিতে বাবার করাত-কলে গিয়েছিলেন, সেটা তার স্পষ্ট মনে আছে। এটি ১৯৯৭ সালের একটি রবিবার ছিল।

"আমি করাতের চারপাশে খেলছিলাম, আর তখন যন্ত্রটি আমাকে জ্যাকেট-সমেত টেনে নেয়, আমার দুই হাত ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেলে, আর একপাশে ফেলে দেয়," তিনি সচেতনভাবে বর্ণনা দিলেন। জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা তার স্মৃতিতে এমনভাবে ফুটে উঠেছে, যেন এটা গতকালেরই ঘটনা। তিনি বলেন যে, কীভাবে গ্রামের লোকেরা বলেছিল-"এ মারা গেছে, কবর দাও", কীভাবে এক প্রতিবেশী সেনা-ক্যাম্পের কাছে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিল; কীভাবে সেনারা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিল এবং বারামুল্লার হাড় ও জয়েন্ট-এর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, এবং কীভাবে তার বাবা বশির আহমেদকে তার চিকিৎসার জন্য নিজেদের জমি বিক্রি করতে হয়েছিল।

বছরের পর বছর হাসপাতালে থাকার পর আমির যখন বের হলেন সেটা ছিল "অনেকটা কাশ্মীরের শীতের পরে বসন্ত আসার মতো", কিন্তু তিনি শুনতে পান গ্রামবাসীরা তার বাবা-মাকে 'কাজের' পরামর্শ দিচ্ছেন যেমন- "ওকে বিষ দিয়ে ইনজেকশন দিন, ও মূল্যহীন" এবং "শুধু টেবিলে খাবারটুকু রাখুন, ও মুখ দিয়ে খাবে”। তার প্রিয় দাদী ফাজি (যিনি ২০১০ সালে মারা যান) ছিলেন তার "সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু", যিনি তাকে লালনপালন করেছিলেন, তার অশান্ত মনকে শান্ত করেছিলেন এবং তাকে মারহামা গ্রামের স্কুলে যেতে রাজি করিয়েছিলে

প্রতিটি অপমানজনক ঘটনা আমিরকে প্রতিটি দৈনন্দিন কাজের জন্য নিজের পায়ে খাপ খাইয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ওয়াজু (প্রথাগত স্নান) করতে অক্ষম হওয়ায় একটি মসজিদ থেকে দূরে সরিয়ে দিলে তিনি নিজেকে স্বাস্থ্যবিধি শিখিয়েছিলেন। এক প্রতিবেশীর ওয়াজওয়ানে (কাশ্মীরি বিবাহের ভোজ), যখন কেউ তাকে খাওয়ানোর জন্য মাথা ঘামায়নি, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে আসেন; কিন্তু পরে তিনি ফাজির কাছে একটি চামচ চেয়েছিলেন যাতে তিনি এটি চালানো শিখতে পারেন। ফাজি তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন: "ঈশ্বর যেন তোমাকে কখনও নির্ভরশীল না ক

তিক্ত অভিজ্ঞতা আমিরকে কখনও অন্যের উপর নির্ভর না করতে শিখিয়েছে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়তে, স্কুলে হেঁটে যাওয়ার সময় বোতাম ছিটকে পড়লে তার ট্রাউজার খুলে যায়। তিনি রাস্তা থেকে একটি খন্দে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং পথচারীদের সাহায্য করতে বলেন কিন্তু কেউ তা করেনি। অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত তিনি লুকিয়ে রইলেন, দাঁত দিয়ে ট্রাউজার তুলে মাঠের মধ্যে দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। একজন শিক্ষক আমিরের সহপাঠীকে লিখতে সাহায্য করতে বললে ছেলেটি উত্তর দেয়, "আমি তার চাকর নই।" তাই স্কুলের পর, আমির আখরোট গাছগুলিতে পাথর ছোড়েন, পড়ে থাকা বাদামগুলো একটা মুদি দোকানির কাছে ৫ টাকায় বিক্রি করে একটি কলম কিনে নেন। একজন কাপড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি কয়েকটি তাগা (গাঁটের ভিতর পিচবোর্ডের শীট) পান, সেগুলোকে থুতনি এবং কাঁধের মধ্যে আঁকড়ে ধরেন এবং সেগুলিতে লেখার চর্চা করতে বাড়িতে চলে যাএই ধরনের জেদই তাকে শেভ করতে বাধ্য করেছিল— যখন নাপিতের সঙ্গে তিনি ঝগড়া করেছিলেন কারণ গ্রামের একজন ভিআইপি লাইনে আগে ঢুকে যান। ঝিলম নদীতে ছেলেদের লাফানো দেখে তিনিও ঝাঁপ দেন এবং প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই এক মহিলা তাকে উদ্ধার করেন। হতাশ না হয়ে অন্য একদিন ফিরে এসে তিনি দেখেছিলেন যে হাঁসগুলি কীভাবে "নিজেদের পা দিয়ে জল ঠেলে দেয়"। তিনি তাদের অনুকরণ করতে শুরু করেন।

তার শৈশবের ক্রিকেট উন্মাদনা শুরু হয়েছিল যেদিন তিনি এক চোখে একটি ম্যাচ দেখেছিলেন! তিনি তার এলাকার একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে টিভি দেখতেন, কিন্তু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় বাড়ির মালিক তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। তারা জানালাটাও বন্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু তাতে একটা সরু ফাটল ছিল যেটা দিয়ে তিনি কুঁকড়ে তাকালেন। শচীন টেন্ডুলকার ৯০ রান করেন, ভারত জিতেছিল, এবং আমির ক্রিকেটে আসক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। একটি হাতে বানানো কাঠের বল এবং ব্যাট দিয়ে তিনি এক সহৃদয় ফাজির সঙ্গে খেলতেন, বল ধরতে তার পায়ের বুড়ো আঙুল এবং দ্বিতীয় আঙুল ব্যবহার করে এবং ব্যাটটি তার থুতনির নীচে টেনে নিয়ে যান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন চলেছ

একটি মধুর স্মৃতি হল যখন তিনি দশম শ্রেণিতে ছিলেন তখন গ্রামের একটি ম্যাচে তার প্রথম ক্রিকেট খেলা। তার প্রথম বল একজন ব্যাটসম্যানকে ছিল যিনি সবেমাত্র পরপর দুটি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন, যা ছিল এক নিখুঁত ইয়র্কার। তিনি তার প্রথম ওভারে দুটি উইকেট নেন, ১০ রানে অপরাজিত থাকেন এবং ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন। ২০১৬ সালে তিনি জে এবং কে প্যারা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন; একই বছর অজয় ​​জাদেজা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ভারতের খেলা দেখার জন্য মুম্বাইতে তার ট্রিপ স্পন্সর করেছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি যখন পাঞ্জাব স্বাভিমান পুরস্কার জিতেছিলেন, তখন প্রধান অতিথি নভজ্যোত সিং সিধু তাঁর প্রশংসায় একটি গালিবের দুই পংক্তি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন।

আমরা যখন আমিরের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তখন তিনি পরের দিনের অনন্তনাগের একটি ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি হল শচীন স্বাক্ষরিত একটি ব্যাট এবং তার স্বপ্ন হল তার ‘গুরু’র সঙ্গে দেখা করা।

ছবি:

ভিকি রয়